অন্ধকার যাত্রায় যেভাবে চিরঅন্ধকারে হারাল টাইটান

সঞ্জয় দে, টিবিএন ডেস্ক

জুলাই ৬ ২০২৩, ১৮:২৪

নর্থ অ্যাটলান্টিকের গভীরে ধ্বংস হওয়া সাবমার্সিবল ‘টাইটান’। ফাইল ছবি

নর্থ অ্যাটলান্টিকের গভীরে ধ্বংস হওয়া সাবমার্সিবল ‘টাইটান’। ফাইল ছবি

  • 0

ক্রিস্টিন দাউদ তার স্বামী শাহজাদা ও ছেলে সুলেমানকে শেষবার দেখেছিলেন সৈকত থেকে প্রায় ৪০০ মাইল দূরে নর্থ অ্যাটলান্টিকের বুকে দোদুল্যমান একটি ভাসমান প্ল্যাটফর্মে। দিনটি ছিল ১৮ জুন, ফাদার্স ডে। সাপোর্ট শিপ থেকে ক্রিস্টিন দেখছিলেন, বাবা ও ছেলে ২২ ফুট দীর্ঘ সাবমার্সিবল টাইটানে আরোহণ করেছে।

মহাসাগরের প্রায় ১৩ হাজার ফুট গভীরে পড়ে থাকা ১১১ বছরের পুরোনো টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার উদ্দেশে যাত্রা করছিল সাবমার্সিবলটি। পানিতে নামানোর আগে আরোহীদের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শক্ত করে আটকে দেয়া হয়। ভেতরে চালকসহ আরোহী ছিলেন পাঁচজন।

১৯ বছরের সুলেমান একটি রুবিকস কিউব নিয়ে এতে চড়েছিলেন। শাহজাদা নিয়েছিলেন একটি নিকন ক্যামেরা। টাইটানের একমাত্র পোর্টহোলের মাধ্যমে এই ক্যামেরার সাহায্যে সাগরতলের দৃশ্য ধারণ করবেন তিনি।

যাত্রা শুরুর সময় মেয়ে আলিনাকে নিয়ে সাপোর্ট জাহাজে ছিলেন ক্রিস্টিন। স্বামীর যাত্রার শুরুর সময়টিকে মনে করে তিনি বলেন, ‘ও ছিল শিশুর মতো উচ্ছ্বল।’

আকাশে তখন উজ্জ্বল সূর্য। মহাসাগরের বুকে ভাসমান জাহাজটি স্থির।

ক্রিস্টিন দাউদ বলেন, ‘এটি এক সুন্দর সকাল ছিল।’

শিগগিরই প্ল্যটফর্ম থেকে টাইটানকে পানিতে নামিয়ে দেয়া হয় এবং কিছু মানুষের স্বপ্নপূরণে এটি নেমে যায় সাগরের গভীরে।

সেই সকালেই কিছুক্ষণ পরে মিসেস দাউদ একজনকে বলতে শোনেন, টাইটানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইউনাইটেড স্টেটস কোস্ট গার্ড নিশ্চিত করেছে, ঘটনাটি ঘটেছে টাইটান ডুব দেয়ার ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে।

মিসেস দাউদ ব্রিজে ছুটে যান। সেখানে একটি দল টাইটানের গতির উপর নজর রাখছিল। তাকে আশ্বস্ত করা হয়, ক্যাপসুল ও জাহাজের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা হয় একমাত্র কোডেড কম্পিউটার টেক্সট বার্তার মাধ্যমে। সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা এক ঘণ্টার বেশি হলে ডাইভটি বাতিল হয়ে যাবে। আর টাইটান ওজন কমিয়ে সাগর পৃষ্ঠে ফিরে আসবে।

এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলে মিসেস দাউদের ভয় তীব্র হতে থাকে। শেষ বিকেলে তাকে এক জন বলেন, তারা জানেন না টাইটান ও এর আরোহীরা কোথায়।

মিসেস দাউদ বলছিলেন, ‘আমি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, এই বুঝি টাইটানের উপরিভাগ দেখা যায়!’

টাইটানে চড়ার আগে ছেলে সুলেমানের সঙ্গে শাহজাদা দাউদ (বাঁয়ে)

চার দিন পর মিসেস দাউদ যখন সাপোর্ট জাহাজের ক্রুদের সঙ্গে ঠিক একই জায়গায় ভাসছিলেন, কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তারা তখন ঘোষণা করেন- তারা টাইটানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন।

তারা বলেন, টাইটান সম্ভবত বিস্ফোরিত হয়েছিল এবং এর আরোহীদের সবাই তাৎক্ষণিক মারা যান।

শাহজাদা দাউদ ও তার ছেলে ছাড়াও টাইটানে ছিলেন ৭৭ বছর বয়সী ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী পল-হেনরি নারজিওলেট। এবারেরটি নিয়ে তিনি মোট ৩৮ বার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলেন। আরোহী হিসেবে আরও ছিলেন ব্রিটিশ এয়ারলাইন এক্সিকিউটিভ ৫৮ বছর বয়সী হ্যামিশ হার্ডিং। আর ছিলেন ওশানগেটের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী ৬১ বছর বয়সী স্টকটন রাশ, যিনি বিজ্ঞানকে পর্যটনের সঙ্গে মেলাতে চেয়েছিলেন।

টাইটান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন মিস্টার রাশ। তিনি একজন উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন, আর চেয়েছিলেন নিয়ম ভাঙার জন্য স্মরণীয় হবেন।

‘তার (শাহজাদা দাউদ) মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল উজ্জ্বল আভা’

স্টকটন রাশ ও তার স্ত্রী ওয়েন্ডি গত ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনে যান এবং ওয়াটারলু স্টেশনের কাছে একটি ক্যাফেতে দাউদের সঙ্গে দেখা করেন।

তারা সাবমার্সিবলের নকশা ও নিরাপত্তা এবং এতে চড়ে পানির নিচে যেতে কেমন লাগে সেসব নিয়ে কথা বলেন।

মিসেস দাউদ সে সময়কার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এই দিকটি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। মানে, ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে তা না জেনেই আপনি যেভাবে প্লেনে চড়ে বসেন।’

শাহজাদা দাউদ পাকিস্তানের অন্যতম ধনী পরিবারের একজন সদস্য। ৪৮ বছর বয়সী দাউদ ছিলেন একজন ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ব্যবসায়ী। তিনি এনগ্রো করপোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এটি কৃষি, জ্বালানি ও টেলিযোগাযোগ খাতের সঙ্গে জড়িত একটি ব্যবসায়িক সংস্থা, যার প্রধান কার্যালয় বন্দর শহর করাচিতে।

টাইটানিকডুবির ১০০তম বার্ষিকীতে ২০১২ সালে সিঙ্গাপুরে একটি প্রদর্শনী দেখার পর ঐতিহাসিক জাহাজটির প্রতি দাউদের মুগ্ধতা তৈরি হয়। প্রদর্শনীর ডিসপ্লের কিছু আইটেম সম্ভবত মিস্টার নারজিওলেট সাগরতল থেকে তুলে এনেছিলেন।

(বাঁ থেকে) পল-হেনরি নারজিওলেট, স্টকটন রাশ ও হ্যামিশ হার্ডিং

পরিবারটি ২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ডে ঘুরতে যায়। সে সময়ে হিমবাহগুলোর আসবার্গে পরিণত হওয়ার দৃশ্যে সবাই মোহিত হয়েছিলেন। মিসেস দাউদ ওশানগেটের একটি বিজ্ঞাপনও দেখতে পান যাতে টাইটানিক ভ্রমণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতে পরিবারের সবার মাথা ঘুরে যায়, বিশেষ করে শাহজাদা ও সুলেমানের। তবে ডাইভের জন্য সুলেমানের বয়স তখন বেশ কম। ওশানগেটের যাত্রীদের ন্যূনতম ১৮ বছর হওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। আর তাই ক্রিস্টিন তার স্বামীর সঙ্গে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।

তবে এতে বাগড়া দেয় করোনা মহামারি। মহামারি শেষে সুলেমান টাইটানে চড়ার মতো বয়সে পৌঁছে যান। ওশানগেটও তাদের নিয়ম কিছুটা শিথিল করে ১৭ বছর বয়সী অ্যালিনাকে সাপোর্ট শিপে থাকার অনুমতি দেয়। পরিবারটি একসঙ্গে এই ডাইভের অভিজ্ঞতা নিতে চেয়েছিল। আর তাই মিস্টার রাশ মা ও মেয়েকে সাপোর্ট শিপে থাকার অনুমতি দেন।

ওশানগেটের মতো উত্তজনাপূর্ণ উদাহরণগুলো সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে এবং কখনও কখনও বাস্তব জীবনে পাওয়া যায়। এই যেমন একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী (অথবা কারও কারও কাছে একজন রহস্যময় পাগলাটে মানুষ) তার বিরল বা ব্যয়বহুল আবিষ্কারের আভাস দেন এবং কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি এ বিষয়ে নিজের কৌতূহল দমন করতে পারেন না।

তবে টাইটান মোটেও জুরাসিক পার্কের ডাইনোসর বা উইলি ওয়াঙ্কারের দেয়া কোনো মিষ্টিদ্রব্য ছিল না। এটি ছিল সমুদ্রের তলদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ মাত্র ২১ ইঞ্চি পোর্টহোলের মাধ্যমে সরাসরি দেখার সুযোগ।

ভ্রমণের টিকিটের দাম নেহায়েত কম নয়, আড়াই লাখ ডলার। অবশ্য বিজ্ঞাপনে দেয়া টিকিটের এই দাম নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ আছে।

মিস্টার রাশ নিজেকে একজন সেলসম্যানের চেয়ে একজন বিজ্ঞানী ভাবতেই ভালবাসতেন। তবে তার বেশিরভাগ চেষ্টা ছিল নিজের কোম্পানির বিপণন এবং সাবমার্সিবলের টিকিট বিক্রি করা। তিনি ক্লায়েন্টদের এমন একটি সমাবেশ চাইতেন যারা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রচারধর্মী। সম্ভাব্য ক্লায়েন্টরা সরাসরি তার সঙ্গে বোঝাপড়া করতেন।

কলোরাডোর প্লানেটরি বিজ্ঞানী অ্যালান স্টার্ন গত বছরের জুলাইয়ে টাইটান ডাইভ সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। মিস্টার রাশ যখন জানতে পারেন মিস্টার স্টার্ন একজন জেট পাইলট এবং নাসার নিউ হরাইজন অনুসন্ধান দলের নেতা তখন তিনি তাকে বিনামূল্যে একটি টিকিট অফার করেছিলেন।

সে সময়ের কথা স্মরণ করে মিস্টার স্টার্ন বলেন, ‘স্টকটন আমায় বলেছিলেন, আপনি কথা বলতে চাইলে আমার সমস্যা নেই- আপনি কি কো-পাইলট হতে চান? আমরা আপনাকে প্রশিক্ষণ দেব। সেন্ট জনস-এ চলে আসুন।’

মিস্টার নারজিওলেটও ছিলেন টাইটানিক পরিবারের একজন আধা-সদস্য, ওশানগেট অভিযানের একজন তারকা এবং কো-পাইলট।

তিনি টাইটানিকে ডাইভ দিয়ে জাদুঘর ও প্রদর্শনীর জন্য বিভিন্ন বস্তু সংগ্রহ করতে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন। প্যারিসে আগামী ১৮ জুলাই টাইটানিক নিয়ে তিনি একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

মিস্টার নারজিওলেট ২০২২ সালে ‘ড্যান্স লেস প্রফন্ডেউরস ডু টাইটানিক (টাইটানিকের গভীরতায়)’ শিরোনামে একটি বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার সমস্ত অস্তিত্ব একে কেন্দ্র করে ঘুরছে।’

টাইটানের ভেতরের দৃশ্য। ফাইল ছবি

শেষ অভিযানের আগে মিস্টার নারজিওলেট টাইটানিকে তার আগের ৩৮টি ডাইভ নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দেন। মিসেস দাউদ বলেন, ওই প্রেজেন্টেশনের সময় মিস্টার নারজিওলেট একটি ঘটনা বলেছিলেন। আর তা হলো একবার তিনি সাগরের গভীরে তিন দিন আটকে ছিলেন এবং সে সময় সাবমার্সিবলের সঙ্গে বাইরের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ঘটনাটি শোনার পর শাহজাদা দাউদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন।

‘ওহ, ঈশ্বর, সব কিছু কত সুন্দর ছিল’- মিসেস দাউদ স্মরণ করেন। স্বামীর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিনি সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলেন। তার মুখজুড়ে খুশির আভা ছড়িয়ে পড়েছিল।’

আর তাই এমন এক দুঃসাহসী অভিযানে সবাই যোগ দিয়েছিল। দলটিতে ছিলেন ধনী পর্যটক এবং কৌতূহলী বিজ্ঞানী। তাদের একটি বিরল দুঃসাহসিক অভিযানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকৃষ্ট করেছিল এমন একটি কোম্পানি যারা নিজেদের সমুদ্রের ‘স্পেসএক্স’ বলে দাবি করে।

ওশানগেট মহাকাশ ভ্রমণের পরিভাষায় নিজেদের সাজিয়েছিল। এতে আছে ‘কমান্ড সেন্ট্রাল’, একটি ‘মিশন ডিরেক্টর’, ‘লঞ্চ অ্যান্ড রিকভারি প্ল্যাটফর্ম (এলএআরএস)’ এবং একটি ‘উৎক্ষেপণের কাউন্টডাউন’ ছিল।

অর্থের বিনিময়ে ভ্রমণকারীদের ‘মিশন বিশেষজ্ঞ (মিশন স্পেশালিস্ট)’ বলা হতো এবং সংস্থাটি জানিয়ে রাখত তাদের ‘গ্রাহক’, ‘পর্যটক’ বা ‘যাত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করা হবে না। তাদের নাম ও দেশের পতাকা সম্বলিত শার্ট ও জ্যাকেট দেয়া হতো। এর হাতার উপর একটি প্যাচ লেখা ছিল, ‘টাইটানিক সার্ভে এক্সপ্লোরেশন ক্রু।’

মিস্টার নারজিওলেট তার বইয়ে লিখেছেন, ‘পকেট সাবমেরিনে গভীর পানিতে ডাইভিং হলো একটি চরম কার্যকলাপ যাতে প্রশিক্ষণ ও বয়স নির্বিশেষে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী যে কেউ অংশ নিতে পারেন।’

জে ব্লুম নামে লাস ভেগাসের একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী এ বছর তার ২০ বছর বয়সী ছেলে সিনকে নিয়ে টাইটানে যেতে চেয়েছিলেন। দরকষাকষির পর মিস্টার রাশ গত এপ্রিলে ১ লাখ ডলার ছাড় দিয়ে টিকিটের ‘চূড়ান্ত দাম’ দেড় লাখ হাকান। তবে সময় জটিলতা ও নিরাপত্তা শংকায় মিস্টার ব্লুম শেষ অবধি পিছিয়ে যান।

ওশানগেট ২০২১ সাল থেকে বসন্তের শেষের দিকে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে আট বা নয় দিনের টাইটানিক অভিযান পরিচালনা করছিল। এর মধ্যে প্রায় দুই দিন টাইটানিক সাইটে, পাঁচ দিন সাগরে এবং তীরে ফিরতে দুই দিন অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রতিটি অভিযানে একাধিক ডাইভ থাকতে পারে, তবে প্রতি ক্লায়েন্টের জন্য ডাইভ দেয়ার সুযোগ মাত্র একবার।

সবশেষ ট্রিপটি ছিল মিশন ফাইভ। এর আগে চলতি বছরের মে ও জুনের শুরুতে চারটি মিশন পরিচালিত হলেও রুক্ষ আবহাওয়ার কারণে কোনোটিই টাইটানিকের কাছাকাছি যেতে পারেনি।

হ্যামিশ হার্ডিং তার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে ডাইভের আগের বিকেলে লেখেন, ‘অবশেষে ঘোষণা করতে পেরে আমি গর্বিত যে, @oceangateexped-এর RMS TITANIC মিশনে আমি যোগ দিয়েছি। টাইটানিক দেখাতে যাওয়া সাবে (সাবমার্সিবল) আমি একজন মিশন স্পেশালিস্ট হিসেবে আছি।’

৫৮ বছর বয়সী হার্ডিং দুবাইভিত্তিক একটি বিক্রয় এবং বিমান পরিচালনা সংস্থা- অ্যাকশন এভিয়েশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এর আগে জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন রকেট কোম্পানির মাধ্যমে মহাকাশে গিয়েছিলেন।

মিস্টার হার্ডিং চারটি ছবি পোস্ট করেন, যার মধ্যে একটি সাবমার্সিবলের। আরেকটি ছিল ছোট সাদা পতাকার ছবি, যেখানে অভিযানের সদস্যরা কালো মার্কারে নাম স্বাক্ষর করেছেন।

আরেকটি ছবিতে পা আড়াআড়ি করে বসা হাসি মুখের মিস্টার হার্ডিং। তার পাতলা লালচে চুল। সব আবহাওয়ায় চলনসই চেনখোলা জ্যাকেটের নিচে একটি রাগবি-স্টাইলের শার্ট, ব্লু জিনস, নাসা-থিমের মোজা এবং রানিং শু পরা ছিলেন তিনি।

মহাসাগরের তল থেকে উদ্ধার করা টাইটানের ধ্বংসাবশেষ

পোস্টে মিস্টার হার্ডিং আবহাওয়ার চ্যালেঞ্জের বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তবে এর মধ্যেই পরদিন ভোর ৪টার দিকে তার গ্রুপের সাগরে নামার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিলেন।

তিনি লিখেছেন, ‘তখন পর্যন্ত আমাদের অনেক প্রস্তুতি এবং ব্রিফিং করার আছে। আবহাওয়া এমন থাকলে অনুসরণ করার জন্য অভিযানের আরও আপডেট আসবে!’

এটিই ছিল তার শেষ পোস্ট।

রকিং দ্য বোট

ওশানগেট-এর প্রায় ছয় মিনিটের প্রচারমূলক ভিডিওতে রয়েছে মনে ঢেউ তোলা মিউজিক এবং অভিযাত্রীর প্রশস্ত হাসি। এমন ভারসাম্যই কোম্পানির পক্ষ থেকে হৃদয়ে প্রথিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

একটি পুরুষকণ্ঠে বলা হয়, ‘জুলস ভার্ন যা কল্পনা করতে পারতেন তার জন্য প্রস্তুত হোন, এটি পর্যটকের জন্য কোনো রোমাঞ্চকর রাইড নয়- এটি তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু।’

পুরো আয়োজনটি কিছু বিশেষজ্ঞকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল, এদের মধ্যে অন্তত একজন ছিলেন প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মী। সাবমার্সিবল বিশেষজ্ঞদের মধ্যে টাইটানের নলাকার নকশার সমালোচনা ছিল (অধিকাংশ গভীর পানির সাবমার্সিবল গোলাকার হয়); অপেক্ষাকৃত বড় পোর্টহোল (মিস্টার রাশের মতে সাত ইঞ্চি পুরু ও প্লেক্সিগ্লাসের তৈরি) এবং মিশ্র পদার্থের ব্যবহার (যেমন কার্বন ফাইবার ও টাইটানিয়াম, যেগুলি ভালোভাবে যুক্ত থাকতে বা গভীর সমুদ্রে পানির প্রবল চাপ সহ্য করতে পারে না)।

মেরিন টেকনোলজি সোসাইটির ম্যানড আন্ডারওয়াটার ভেহিক্যালস কমিটির চেয়ারম্যান উইল কোহেন ২০১৮ সালে মিস্টার রাশের জন্য একটি চিঠির খসড়া তৈরি করেন। এতে বলা হয়, ওশানগেটের ‘পরীক্ষামূলক’ পদ্ধতির ‘বিপর্যয়কর’ পরিণতি হতে পারে। এই চিঠিতে কয়েক ডজন বিশেষজ্ঞ সই করেছিলেন।

পরের বছর একজন সাবমার্সিবল বিশেষজ্ঞ বাহামায় টাইটান ডাইভের সময় ক্র্যাকিংয়ের শব্দ শুনতে পান। এরপর তিনি মিস্টার রাশকে একটি ইমেলে অপারেশন স্থগিতের অনুরোধ করেন। মিস্টার রাশ কিছু সংশোধনী আনেন বটে, তবে আগের মতোই তিনি গ্রাহকদের টানতে থাকেন।

ক্যালিফোর্নিয়ায় সাবেক ব্যবসায়ী বিল প্রাইস ২০২১ সালে টাইটানে ডাইভে নিমেছিলেন। পানির গভীরে যাওয়ার সময় মিস্টার রাশ বুঝতে পারেন টাইটানের একদিকে প্রপালশন সিস্টেম অচল হয়ে পড়েছে। এরপর তিনি ট্রিপটি বাতিল করেন। মিস্টার প্রাইস বলেন, তবে পানির উপরে উঠে আসার জন্য মিস্টার রাশ যে ‘ড্রপ-ওয়েট মেকানিজম’-এর কথা বলেছিলেন সেই ব্যালাস্ট তিনি সে সময় কাজে লাগাতে পারেননি।

মেক্সিকান সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাবশালী অ্যালান এস্ট্রাদারকে দেয়া এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে মিস্টার রাশ ব্যালাস্ট সিস্টেমটি ব্যাখ্যা করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল ৩৭ পাউন্ড ওজনের ছয়টি ২৪ ইঞ্চি পাইপ, যেগুলো জরুরি পরিস্থিতিতে টাইটানের ওজন কমাতে একে একে অবমুক্ত করে দেয়া হতো।

সাপোর্ট শিপ দ্য পোলার প্রিন্স

ওই সাক্ষাৎকারে মিস্টার রাশ শান্তভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, এই ওজনগুলো কোনো স্টপার ছাড়াই সাবমার্সিবলের উপরে লোড করা হয়েছে। তাই জরুরি সময়ে টাইটানকে যথেষ্ট মাত্রায় দোলালে সেগুলো অবমুক্ত হয়ে যাবে।

প্রত্যেকে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে সামনের দিকে ছুটে গেলে, এরপর আবার পিছিয়ে এলে, বারবার এটি করলে টাইটান দুলতে থাকবে এবং ব্যালাস্টগুলো খুলে পড়বে।

মিস্টার প্রাইস বলেন, ‘এভাবে অনেকবার ছোটাছুটির পর আমরা গতি পেতে শুরু করলাম। তারপর একটি ধাতব ঠোকাঠুকির শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম একটি ব্যালাস্ট খুলে পড়েছে। আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে একই কাজ করলাম যতক্ষণ না সব ওজন অপসারিত হয়।’

এই দুর্বলতা অবশ্য টাইটানের পরের দিনের ডাইভ ঠেকাতে পারেনি। মিস্টার প্রাইস জাহাজে ছিলেন, পরবর্তী দিন তারা টাইটানিক দেখেছিলেন এবং সাগর তলে স্পার্কলিং সিডার দিয়ে এই দৃশ্য উদযাপন করেছিলেন।

মিস্টার প্রাইস বলছিলেন, ‘এটা সত্যি আমরা এর মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম, আমরা কিছু খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। আবার তা কাটিয়ে উঠতেও পেরেছি। সবশেষে আমার মনে হয়িছিল, আমরা এটি করতে পারি।’

ওশানগেট কোনো গ্যারান্টি ছাড়াই বলত, টাইটানিকের কাছে পৌঁছাতে টাইটানের প্রায় আড়াই ঘণ্টা এবং ফিরে আসতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগবে। মাঝখানে প্রায় চার ঘণ্টা ধ্বংসাবশেষ দেখানো হবে।

বেশিরভাগ ট্রিপ টাইটানিকের কাছাকাছি যেতে পারেনি। এর চেয়ে অনেক বেশি মিশন শেষ হওয়ার আগেই বাতিল করা হয়েছে।

এরপরেও মিস্টার রাশের প্রতি যাত্রীদের আস্থার কারণ ছিল যেকোনো সমস্যায় তার আচরণের স্বচ্ছতা। কয়েক সপ্তাহ আগে কম্পিউটার সংযোগের জটিলতায় একটি পরীক্ষামূলক ডাইভ বাতিল হওয়ার পর মিস্টার রাশ সবাইকে ডেকে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

এই মিশনে থাকা এক ইউটিউবারের ভিডিওতে মিস্টার রাশকে বলতে শোনা যায়, ‘বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আমি এখানে সবাইকে ডেকেছি। নিয়ন্ত্রণ সমস্যাটি কী তা আমাদের খুঁজে বের করতে হয়েছে। সাবকে (সাবমার্সিবল) নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

অ্যারোনটিক্সের অভিজ্ঞতাসম্মৃদ্ধ প্লানেটরি বিজ্ঞানী মিস্টার স্টার্ন বলছেন, দুর্ঘটনার পর থেকে যে উদ্বেগ প্রকাশ্যে এসেছে তার কিছু সম্পর্কে তিনি জানেন না। তিনি বরং অভিযান শেষে প্রটোকলে মুগ্ধ হয়ে নিরাপদে ফিরেছেন।

মিস্টার স্টার্ন বলেন, ‘আমার নিজের অনুমান ছিল টাইটান কয়েক ডজন বার ডুব দিয়েছে। এর সবগুলো টাইটানিকের দিকে নয়। আমার জন্য এটি একটি অভিজ্ঞতামূলক যাত্রা ছিল যাতে মনে হয়েছে তারা একটি বেশ নির্ভরযোগ্য, নিরাপদ অপারেশন চালাচ্ছে।’

মিস্টার প্রাইস গভীর সাগরে পানির প্রচণ্ড চাপে পিষ্ট হওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে তা ব্যাখ্যার জন্য কিছু উপমা স্মরণ করেছেন। একটি হলো কোকের একটি ক্যান স্লেজহ্যামার দিয়ে চূর্ণ করে ফেলা। আরেকটি হলো একটি হাতি এক পায়ে দাঁড়িয়ে, তার উপরে আরও ১০০টি হাতি।

এমন অবস্থায় মৃত্যু হবে তাৎক্ষণিক।

মিস্টার প্রাইস বলেন, ‘একটি ভয়ঙ্কর উপায়ে নিশ্চিত মৃত্যু।’

পোলার প্রিন্সের উপর

নর্থ অ্যামেরিকা মহাদেশের পূর্ব প্রান্তে নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জনসের একটি সংকীর্ণ পোতাশ্রয় থেকে থেকে সবগুলো অভিযান শুরু হয়েছিল।

দাউদরা ১৪ জুন টরন্টোতে উড়ে যান। সেন্ট জনসে যাওয়ার একটি ফ্লাইট বাতিল হলে তারা শহরটি ঘুরে দেখার জন্য কিছুটা সময় পান। তবে পরের দিনের ফ্লাইটও বিলম্বিত হলে টাইটানিক অভিযাত্রাটি ভণ্ডুল হওয়ার শংকা তৈরি হয়।

মিসেস দাউদ বলেন, ‘আমরা আসলেই বেশ চিন্তিত ছিলাম। ওহ মাই গড, যদি তারা ওই ফ্লাইটটিও বাতিল করে দেয়! এখন মন হয় সেটা ঘটাই উচিত ছিল।’

তারা মধ্যরাতে পৌঁছে সরাসরি পোলার প্রিন্সে যান। এটি ক্যানাডিয়ান কোস্ট গার্ডের একটি সাবেক আইসব্রেকার যা নির্মিত হয় ১৯৫৯ সালে। বর্তমানে এটি ওশানগেট ব্যবহার করেছে।

এতে গাঢ় নীল রঙা হল এবং ১৭ জন ক্রু ছিলেন। প্রায় দুই ডজন ওশানগেট ডাইভার ও স্টাফের পাশাপাশি ক্লায়েন্টদেরও এখানে রাখা হয়। এই বসন্তে ২০ বর্গফুটের একটি ভাসমান প্ল্যাটফর্মের ওপর ২০ হাজার পাউন্ডের টাইটান সাবমার্সিবলটিকে চড়িয়ে পোতাশ্রয়ের ভিতরে-বাইরে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

দাউদরা জাহাজে ওঠার পর কেবিনে থাকার ব্যবস্থা হয়। স্বামী-স্ত্রীর জন্য ছিল বাঙ্ক বেড। ক্রিস্টিন দাউদ উপরের বাঙ্কে শুয়েছিলেন। আর বাচ্চাদের প্রত্যেকের জন্য ছিল নিজস্ব কেবিন। জাহাজের গ্যালিতে সবার জন্য বুফে-স্টাইলে এবং ট্রেতে করে খাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল।

প্রতিদিন সকাল ৭টায় এবং সন্ধ্যা ৭টায় এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে বৈঠক হতো। সবাই কী শিখলো, কী করতে যাচ্ছে, কী ভাবার দরকার আছে এসব নিয়ে সেখানে কথা হতো।

ওশানগেট ব্রোশারে লেখা হয়েছে, ‘মিশন বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ভূমিকা যেমন সাবমার্সিবল নেভিগেশন ও পাইলটিং, ট্র্যাকিং ও যোগাযোগ এবং সাবমার্সিবল রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পান। তারা একটি সাবমার্সিবলের ডাইভ দেয়াার পর সাপোর্ট জাহাজে থাকা অন্য দলগুলোকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করে।’

টাইটানের পাঁচ আরোহীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

রাতে সাধারণত মিস্টার রাশ, মিস্টার নারজিওলেট বা অন্য একজন বিজ্ঞানীর পক্ষ থেকে একটি উপস্থাপনা থাকত। এই বিজ্ঞানীরা হতে পারতেন প্রত্নতাত্ত্বিক থেকে মহাকাশচারী পর্যন্ত যাদের মিস্টার রাশ ক্লায়েন্ট হিসেবে যুক্ত করেছিলেন। অভিযাত্রীরা মেঝেতে বা সোফায় বসে আলোচনা শুনতেন। কখনও কখনও তারা ‘টাইটানিক’ দেখতেন।

মহাসাগরের গভীরে

দিনটি ছিল ১৮ জুন রোববার। ডাইভারদের ভোর ৫টার মধ্যে ডেকে হাজির হতে হয়েছিল।

ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা ও দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর মেজাজ ছিল গম্ভীর। জাহাজর ইঞ্জিনের গুঞ্জন কানে ভেসে আসছিল। এরই মধ্যে ডাইভার ও সাবমার্সিবলের ক্রুরা শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

মিসেস দাউদ বলছিলেন, ‘এটি সবকিছু ঠিকঠাক চলা একটি অপারেশনের মতো ছিল- আপনি দেখতে পাচ্ছেন এ কাজ তারা এর আগেও অনেকবার করেছে।’

ততক্ষণে প্রথমবারের মতো ডাইভে যুক্ত হওয়া তিনজনকে বলা হয়েছে অভিযাত্রায় কী কী ঘটতে পারে এবং প্রত্যাশিত ১২ ঘণ্টার ভ্রমণের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

মিস্টার রাশ ডাইভের আগের দিন কম ফাইবারযুক্ত খাবার এবং যাত্রার দিন সকালে কফি না খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। এর কারণ হলো মিশনে সাবমার্সিবলে পর্দার পিছনে রাখা একটি বোতল বা ক্যাম্প-স্টাইলের টয়লেট যত কম ব্যবহার করা যায়।

তিনি বলছিলেন, ‘সবাই মোটা মোজা ও মাথায় একটি উলের টুপি পরুন, কারণ এটি যত গভীরে যাবে ততই শীতল হতে থাকবে। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে পা ভেজানোর চেষ্টা করবেন না।

‘নিচে যাওয়ার পথে পোর্টহোল বা বাইরের ক্যামেরা দিয়ে কিছু দেখার আশা করবেন না, কারণ সমুদ্রের তলদেশে মহাকাব্যিক দৃশ্যয়নের জন্য ব্যাটারির শক্তি বাঁচিয়ে রাখতে যাত্রাপথে ফ্লাডলাইটগুলো বন্ধ রাখা হবে। অবশ্য চলতি পথে বায়োলুমিনেসেন্ট প্রাণীর ঝলক দেখার সুযোগ পেতে পারেন। এ সময় মনে হবে যেন আকাশ থেকে তারা খসে পড়ছে।

‘টাইটানের ভিতরের আবছা আলোগুলোও একই কারণে বন্ধ রাখা হবে। কেবল কম্পিউটার স্ক্রিন ও কাগজে অবতরণের গভীরতা লেখার লাইটযুক্ত কলম থেকেই একমাত্র আলো পাওয়া যাবে।’

মিস্টার রাশ বলেছিলেন, ‘ব্লুটুথ স্পিকারে চালাতে পছন্দের কিছু গান আপনার ফোনে লোড করে নিতে পারেন। তবে প্লিজ সেগুলো যেন কান্ট্রি মিউজিক না হয়।’

ডাইভারদের ১৮ জুন সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে বোর্ডিংয়ের জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছিল। সুলেমান ও শাহজাদা তাদের ওশানগেট ফ্লাইট স্যুটের পাশাপাশি পানিরোধী ট্রাউজার, কমলা পানিরোধী জ্যাকেট, বুট, লাইফ ভেস্ট ও হেলমেট নিয়েছিলেন।

অ্যাটলান্টিকের অতলে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ

যাত্রার চাহিদা অনুযায়ী তারা দেহের ওজন না বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মিসেস দাউদ স্বামীর কথা স্মরণ করেন। শাহজাদা দাউদ তাকে বলছিলেন, ‘আমাকে বেশ মোটা দেখাচ্ছে। অবশ্য আমি ইতোমধ্যে ভেতরে ফুটতে শুরু করেছি।’

সুলেমান সিঁড়ি বেয়ে মোটর চালিত র‌্যাফটে উঠতে তৎপর হন। এই র‌্যাফট যাত্রীদের টাইটানকে বেঁধে রাখা ভাসমান প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাবে।

শাহজাদাকে কিছুটা কম উৎফুল্ল লাগছিল। তিনি বলছিলেন, ‘এই সমস্ত গিয়ার পরে সিঁড়ি বেয়ে নামার জন্য অতিরিক্ত আরেকটি হাতের প্রয়োজন।’

মিসেস দাউদ বলেন, ‘আলিনা ও আমি কাছেই ছিলাম। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম ও যেন পানিতে পড়ে না যায়।’

ডাইভারদের সবাই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছান। শিগগিরই তাদের সবাই টাইটানে ঢুকে গেলেন।

সাবমার্সিবেলে ওঠাটা অনেকটা এসইউভিতে ওঠার মতো। পিছনের হ্যাচ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। ভেতরে কোনো আসন নেই। মেঝেতে শুধু একটি রাবারের মাদুর এবং ছাদে ধরার জন্য দুটি হাতল রয়েছে।

মিস্টার রাশ ছিলেন পাইলট। তিনি সাধারণত পোর্টহোল থেকে দূরে পিছনে বসে থাকতেন। অন্যরা বাঁকা দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসেন। অতীতের যাত্রীরা কখনও কখনও একটি প্যাডেড সিট কুশনে বসেছিলেন, যেমন আপনি একটি স্টেডিয়ামে নিয়ে আসতে পারেন।

ডাইভাররা হ্যাচ বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ একজন বাইরে থেকে সব বোল্ট শক্ত করে আটকে দিলেন।

অবশেষে ক্রুরা কৌশলে টাইটানকে পানিতে ফেলে দিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

টাইটান সাধারণত প্রতি মিনিটে প্রায় ২৫ মিটার বা ঘণ্টায় প্রায় এক মাইল বেগে পানির গভীরে নামতে পারে। এটি যথেষ্ট ধীর গতি, যা বলতে গেলে কোনো অনুভূতি তৈরি করে না।

ভিতরের আরোহীদের মাথার উপর দিনের আলোর আভা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসতে থাকবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে টাইটানকে ঘিরে ধরবে অন্ধকার এবং পোর্টহোলটি নিকষ কালোয় ভরে উঠবে।


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন