অ্যাটলান্টিকে নিখোঁজ সাবমেরিনের ভেতরটি কেমন?

টিবিএন ডেস্ক

জুন ২১ ২০২৩, ১৮:৪২

গ্রাফিক্স: ডেইলি মেইল

গ্রাফিক্স: ডেইলি মেইল

  • 0

ঠিক যেন রক্ত হিম করা কোনো সিনেমার কাহিনি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার হাজার ফুট নিচে মাত্র ২২ ফুট লম্বা একটি টিউবের ভিতরে আটকে আছেন পাঁচ জন মানুষ। সাবমেরিনটিতে জানালা মাত্র একটি, ভালোভাবে বসার ব্যবস্থাও নেই। বাইরের দুনিয়ার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।

পাকিস্তানি ধনাঢ্য ব্যক্তি ৪৮ বছরের শাহজাদা দাউদ ও তার ১৯ বছর বয়সী ছেলে সুলেমান, ব্রিটিশ ধনকুবের ৫৮ বছরের হামিশ হার্ডিং, ৭৭ বছর বয়সী ফ্রেঞ্চ ডাইভার পল-হেনরি নারজিওলেট এবং সাবমেরিনের চালক ও ওশানগেট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী স্কটনরাশ। নর্থ অ্যাটলান্টিকের গভীরে নিঁখোজ টাইটান সাবমেরিনে আরোহী সব মিলিয়ে এই পাঁচ জন।

একশ বছরেরও বেশি আগে ১৯১২ সালে অ্যাটলান্টিকে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখাতে যাওয়া ওশানগেট কোম্পানির পর্যটকবাহী সাবমেরিন ‘টাইটান’ রোববার যাত্রা শুরুর পৌনে ১ ঘণ্টার মধ্যে নিখোঁজ হয়। বিভিন্ন দেশের সমন্বিত অনুসন্ধান শুরু হলেও এখন পর্যন্ত সাবমেরিনটির অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি।

সাবমেরিনে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন। আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেনের জোগান রয়েছে। এর আরোহীদের শুধু অক্সিজেন স্বল্পতার সঙ্গেই লড়াই করতে হচ্ছে না, গভীর সাগরে ডুবে থাকা এই যানে রয়েছে হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

সাবমেরিনটি এখনও অক্ষত আছে ধরে নিলেও এর সঙ্গে বাইরের বিশ্বের কোনো যোগাযোগ নেই। আরোহীদের কাছে সাহায্য পৌঁছাবে কিনা তাও জানা নেই।

সাবমেরিনটিতে কোনো আসন নেই। যাত্রীদের খালি পায়ে এবং মেঝেতে বসতে হয়। একটি ছোট কালো বাক্সের মতো টয়লেট আছে, যা আড়াল করার জন্য আছে শুধু একটি কালো পর্দা। এই টয়লেটের অংশেই আছে সাবমেরিনটির একমাত্র গোল জানালা। ডুবে যাওয়া টাইটানিক দেখতে আরোহীদের এই জানালা দিয়েই উঁকি দিতে হয়। সাবমেরিনে প্রবেশের ও বের হওয়ারও একমাত্র পথ এটি।

সাবমেরিন টাইটানের এই অংশে আছে একমাত্র দরজা, জানালা ও টয়লেট। ছবি: সংগৃহীত

টাইটান সাবমেরিনটি ক্যানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল থেকে ৩৭০ মাইল দূরে ১২ হাজার ৫০০ ফুট পানির নিচে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখাতে যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়।

টাইটানের দৈর্ঘ্য ২২ ফুট এবং প্রস্থ ৯.৫ ফুট। বাইরে থেকে এটি দেখতে চকচকে ধাতব বস্তুর মতো। এতে প্রবেশ বা বের হওয়ার কোনো দরজা নেই। টাইটান সাগরে নামার আগে ১৭টি স্ক্রু খুলে আরোহীদের ভেতরে ঢোকানো হয় এবং উঠে আসার পরে একই পদ্ধতিতে বের করা হয়।

সাবমেরিনটিতে উন্নত প্রযুক্তি থাকলেও ভেতরের বেশিরভাগটাই ফাঁকা। শুধু একটি বোতাম আছে সাবমেরিনটি চালু করার জন্য। দেয়ালে স্ক্রিন এবং সামনে একটি ছোট পোর্টহোল জানালা রয়েছে সমুদ্রের গভীরতা দেখার জন্য। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষও দেখতে হয় ওই জানালা দিয়ে। সাবমেরিনের ভিতরে বসার কোনো আসন নেই। যাত্রীরা এতে ঢোকার আগে পায়ের জুতা মাদারশিপে রেখে দেন। এরপর মেঝেতে আসন গেড়ে বসে থাকতে হয়।

টাইটানের চালক একটি মডিফায়েড লজিটেক গেমিং কন্ট্রোলারের সাহায্যে এটি পরিচালনা করেন। টুইন থাম্বস্টিক এবং চারটি রঙিন বোতামের কন্ট্রোলারটি সাবমেরিনটিকে উপরে, নিচে, বাঁয়ে, ডানে এবং সামনে ও পিছনে যেতে নির্দেশনা দেয়।

ওশানগেটের তথ্য অনুযায়ী, টাইটানে অত্যাধুনিক আলো এবং সোনার নেভিগেশন সিস্টেমের পাশাপাশি ভিতরে ও বাইরে ফোর-কে ভিডিও ক্যামেরা ও ফটোগ্রাফির আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে।

সাবেক রয়্যাল নেভি কমান্ডার রায়ান রামসে বলছেন, সাবমেরিনটি সমুদ্রের হাজার হাজার ফুট নিচে ডুবে গিয়ে থাকলে সেটি উদ্ধারের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি কারও কাছে নেই।

তবে একটি আশার কথা হলো সেটি পানিতে ভাসতেও পারে। তেমনটি ঘটলে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই হয়ত সেটির অবস্থান শনাক্ত করে আরোহীদের উদ্ধার করা যাবে।

যে সাবমেরিনটি নিখোঁজ হয়েছে সেটি সাইক্লপস-টু মডেলের। ওশানগেট কোম্পানি সাইক্লপস-ওয়ান তৈরির পর টাইটান নামের সাইক্লপস-টু মডেলটি তৈরি করে।

সাবমেরিন টাইটানের অবস্থান শনাক্তে সমুদ্রের তলদেশে রোবট পাঠানো হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ওশানগেট গত এপ্রিলে ভার্জিনিয়ার একটি অ্যামেরিকান ডিসট্রিক্ট কোর্টে বলেছিল, টাইটান নির্বিঘ্নে ২.৪ মাইল গভীরে ডাইভ দিতে সক্ষম। ভূমিতে টাইটানের ওজন ২০ হাজার পাউন্ড হলেও সমুদ্রের তলদেশে এটি স্থির অবস্থানে থাকতে পারে।

পর্যটকদের টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখাতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৫০০ ফুট নিচে নিয়ে যেতে জনপ্রতি ২৫০ হাজার ডলার নেয় ওশেনগেট। যাত্রার আগে পর্যটকদের একটি চুক্তিতে সই করতে হয়। তারা জানেন সাবমেরিনটি কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে অনুমোদিত নয়।

ওশানগেটের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘টাইটানে অনবোর্ড হেলথ অ্যানালাইসিস মনিটরিং সিস্টেম রয়েছে। পাইলটের সময় মতো প্রাথমিক সতর্কতা দেয়া হয়, যাতে যানটিকে নিরাপদে সমুদ্রপৃষ্ঠে ফিরিয়ে আনা যায়।’

নিখোঁজ সাবমেরিনটিতে এক দিনে সর্বোচ্চ পাঁচ জনের অভিযাত্রার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। সাধারণত গভীর সমুদ্র যাত্রায় গন্তব্যে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এরপর অভিযাত্রীরা কয়েক ঘণ্টা টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দর্শন শেষে ফের দুই ঘণ্টার যাত্রায় উপকূলে ফিরে আসেন। পুরো ডাইভটি সব মিলিয়ে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

পাঁচ আরোহী বহনকারী সাবমেরিনটি গত সপ্তাহে কানাডার সেন্ট জন’স বন্দর ছেড়ে যায়। একটি মাদারশিপ এমভি পোলার প্রিন্স একে টাইটানিক ডুবে যাওয়ার এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর সাবমেরিনটি মাদারশিপ ছেড়ে সাগরের ১২ হাজার ৫০০ ফুট পানির নিচে নামতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই পোলার প্রিন্সের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে।

ইউএস কোস্ট গার্ড ফার্স্ট ডিস্ট্রিক্ট কমান্ডার রিয়ার অ্যাডাম জন মাগার বলছেন, নিখোঁজ সাবমেরিনের জন্য প্রথম দিকে মহাসাগরের উপরিভাগে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। উদ্ধারকারীদের দল এখন গভীর পানিতে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

ডিপ এনার্জি নামের পাইপলেয়ার জাহাজ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। এটির ক্যামেরা ব্যবহার করে সমুদ্রতলে অনুসন্ধান চালানো যায়। অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে সহায়তার জন্য ফ্রান্স আটলান্টি নামক একটি জাহাজ পাঠাচ্ছে, যাতে গভীর সমুদ্রে তল্লাশি চালানোর মতো ডাইভিং ভেসেল আছে।

আটলান্টিতে ভিক্টর সিক্স থাউজেন্ড নামে একটি স্বংয়ংক্রিয় রোবট রয়েছে যা পানির ৬০০০ মিটার গভীরতায় অনুসন্ধান চালাতে সক্ষম। তবে আটলান্টি জাহাজটি ঘটনাস্থলে পৌঁছাবে স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যার দিকে। এর মধ্যেই নিখোঁজ সাবমেরিনে অক্সেজেন জোগান শেষ হয়ে যেতে পারে।

সমুদ্রে নিখোঁজ সাবমেরিন টাইটান

অনুসন্ধান এলাকার পানির নিচে থেকে মঙ্গলবার আধা ঘণ্টার বিরতিতে শব্দ শনাক্ত করে ক্যানাডিয়ান একটি বিমান।

সোনারে ধরা পড়া শব্দ সাবমেরিনের যাত্রীদের বেঁচে থাকার আশা সঞ্চার করেছে। হয়ত সাবমেরিনের যাত্রীরা সোনারে শনাক্ত হতে সাবমেরিনের দেয়ালে জোরে আঘাত করছেন।

অবশ্য মঙ্গলবার রাতে পানির নিচে শনাক্তকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সাবমেরিন খোঁজার পদক্ষেপ ‘নেতিবাচক’ ফল দিয়েছে।

ইউএস কোস্ট গার্ডের রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মওগ্যার এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘ আমরা পানির নিচে শব্দ শনাক্ত করার পর সাবমেরিনটিকে খুঁজে পেতে অতিরিক্ত জাহাজ ও সাবমেরিন পাঠাচ্ছি। তবে শব্দের উৎস এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’

বিজ্ঞানী ড. মাইকেল গুইলেন ২০০০ সালে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। তিনি এই মুহূর্তে টাইটানের আরোহীদের অবস্থা অনুমান করে বলছেন, আটকে পড়া আরোহীরা সাবমেরিনের দেয়ালে আঘাতের জন্য কাপ ব্যবহার করতে পারেন।

গুইলেন বলেন, ‘যাত্রার শুরুতে অর্থাৎ দুই ঘণ্টার ভেতরেই হাইড্রোফোন বিকল হয়ে থাকলে তারা কিছুতেই সাবমেরিনটিকে সমুদ্রের গভীরে নিয়ে যেতে পারবেন না। তাদের সমুদ্রতলে থাকার সম্ভাবনা কম।'

তিনি বলেন, ‘আমি যদি ওই সাবমেরিনে থাকতাম তাহলে কাপ দিয়ে দেয়ালে বারবার আঘাত করতাম। আমি নিশ্চিত সাবমেরিনের চালকও যাত্রীদের এটিই করতে বলছেন। তারা পাঁচজন চাইলেই দেয়ালে কোনো কিছু দিয়ে সজোরে একসঙ্গে আঘাত করে একটি শক্তিশালী র‍্যাকেট তৈরি করতে পারেন। পানির ভেতরে তৈরি করা শব্দ ভালোভাবেই স্থানান্তর হতে পারে।’


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন