সম্প্রতি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য বিশ্বসেরা ১৯টি শহরের তালিকা করেছে ব্রিটেইনভিত্তিক গ্লোবাল সিটি গাইড টাইম আউট। ৫০টির বেশি শহরের ২০ হাজারের বেশি স্থানীয়দের মতামতের ভিত্তিতে এ তালিকা করেছে।
তাদের কাছে কেবল এটুকুই জানতে চাওয়া হয়েছে যে, শহরে এদিক-সেদিক যেতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সহজলভ্য কি না।
তালিকায় ইউরোপ ও এশিয়ার কয়েকটি শহর আছে। অ্যামেরিকা থেকে নিউ ইয়র্ক ও শিকাগো এতে জায়গা করতে পেরেছে।
১. বার্লিন
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে স্থানীয়রা বেশ আরামদায়ক ও নিরাপদ বলে জানিয়েছেন। ঠিক সময়ে নিয়মমতোই পাওয়া যায় এসব ট্রান্সপোর্ট সেবা।
বার্লিনের লোকজনের ৯৭ শতাংশ তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্কের প্রশংসা করেছেন। তাই সহজেই এটি তালিকার শীর্ষস্থান দখলে নিয়েছে।
কয়েক দশক ধরে স্থানীয়দের পাশাপাশি ট্যুরিস্টরাও চলাফেরা করার জন্য এখানকার ইউ-বান, এস-বান ও বাস ব্যবহার করছেন।
বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ ইউ-বানে যাতায়াত বেশ আনন্দদায়ক। সকাল থেকে রাত অব্দি খুবই দক্ষতার সঙ্গে গোলকধাঁধার মতো লাইনধরে ছুটে চলে ট্রেনগুলো। নয়টি লাইনজুড়ে ১৭৫টি বিশাল স্টেশন কিছুটা জটিল মনে হতে পারে, তবে এটি ব্যবহার করা খুবই সহজ।
২. প্রাগ
ইউরোপের অন্যতম সুন্দর শহর হলো চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ। এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয় এখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট।
প্রাগের ৯৬ শতাংশ বাসিন্দা তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে দারুণ বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, খুব সহজে ও সুলভে গণপরিবহন ব্যবহার করে শহরে যাতায়াত করতে পারেন।
কেবল সুবিধাজনক নয়, দেখতেও বেশ আকর্ষণীয় এখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট।
অনেকে তো বলেন, প্রাগের মূল সৌন্দর্যই হলো গথিক চার্চ বা চোখ ধাঁধানো রেনেসাঁর সামনে দিয়ে ছুটে যাওয়া ট্রামের দৃশ্য।
তবে মেট্রো আরও ভালো। সহজেই এর তিনটি লাইন ব্যবহার করে যাওয়া যায় শহরের প্রায় প্রতিটি অংশে। প্রতিটি লাইনের আবার রয়েছে নিজস্ব নান্দনিকতা।
যেমন, সবুজ রংয়ের লাইনে দেখা যায় বুদবুদের নকশা, লাল রং চিহ্নিত সি লাইনে দেখা যায় ফিউচারিস্টিক নকশা আর হলদে রঙের বি লাইনের নকশা অনেককে অতীতের কমিউনিস্টদের সময়কাল মনে করিয়ে দেয়।
৩. টোকিও
নিউ ইয়র্কের যেমন আছে সবচেয়ে বেশি স্টেশন, তেমন সাংহাইয়ের আছে সবচেয়ে বেশি ট্র্যাক। তবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি যাত্রী বহনকারী পাবলিক ট্রান্সপোর্টের দেখা মিলবে জাপানে টোকিওতে।
সেখানকার সাবওয়েতে যাত্রীঢলের নানা ভিডিও হরহামেশা দেখা যায়। এই দৃশ্য স্থানীয় লোকজনের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিছক আকারের জন্য সাবওয়ের নেটওয়ার্কটি গোলকধাঁধার মতো মনে হতে পারে।
তারপরও টোকিওর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুব দক্ষভাবে পরিচালিত। জাপানি ভাষা জানেন না এমন যাত্রীরাও এটি সহজে ব্যবহার করতে পারেন। এ কারণে স্থানীয়দের ৯৪ শতাংশ তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে দারুণ বলেছেন। অবশ্য ব্যস্ত সময়ে এই ট্রান্সপোর্ট এড়িয়ে চলাই মনে হয় ভালো।
৪. কোপেনহ্যাগেন
বিশ্বের সবচেয়ে সেরা শহর বলে খ্যাতি আছে ডেনমার্কের কোপেনহ্যাগেনের।
ডেনমার্কের অত্যন্ত স্টাইলিশ শহর এটি। এখানকার রেস্তোরাঁ, মিউজিয়াম, বার এক কথায় অতুলনীয়।
কোপেনহ্যাগেনে যাত্রীদের নিয়ে দিন-রাত ছুটে চলে ট্রেন, বাস ও ওয়াটারবাস সিস্টেম। বেশ নির্ভরযোগ্য ও সহজলভ্য হওয়ায় ৯৩ শতাংশ স্থানীয় এই সিস্টেম পছন্দ করেন।
এক টিকিটেই অর্থাৎ একটি কোপেনহ্যাগান কার্ড দিয়েই সব পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়া যায়।
৫. স্টকহোম
সুইডেনের রাজধানী স্ক্যান্ডি ধাঁচের স্টকহোমের মেট্রো বা টানেলবানা বেশ স্টাইলিশ। এখানকার লোকজন তাদের মেট্রোকে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ আর্ট গ্যালারি বলে ডাকেন।
এর কারণ, স্টকহোমে টানেলবানার বেশিরভাগ স্টেশনে দেখা মেলে ঝলমলে মোজাইক ও নানা থিমের পেইন্টিংয়ের নান্দনিক সৃজনশীলতা।
কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, স্টকহোমের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অর্থাৎ মেট্রো, ট্রাম, বাস ও ফেরি যাত্রী পরিবহনে অত্যন্ত দক্ষ। স্থানীয়দের ৯৩ শতাংশ জানিয়েছেন, নিয়মিত যাতায়াতে তারা সহজেই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পেয়ে যান।
৬. সিঙ্গাপুর
আধুনিক বিশ্বের ট্রান্সপোর্ট হিসেবে সিঙ্গাপুরের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে। শহরটির বাস ও ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা এমআরটির উদ্ভাবন বেশ মানসম্মত। এগুলোকে উন্নত করতে কোনো প্রচেষ্টাই বাকি রাখেনি কর্তৃপক্ষ।
সিঙ্গাপুরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারের জন্য আছে মাইট্রান্সপোর্ট ডটএসজি নামের একটি অ্যাপ। এর মাধ্যমে সহজেই যাত্রাপথের পরিকল্পনা করা যায়। পর্যটকের জন্য আছে সিঙ্গাপুর ট্যুরিস্ট পাস। সবচেয়ে ভালো দিক হলো, সেখানকার সব ট্যুরিস্ট স্পটগুলো থেকে হাঁটার দূরত্বেই পাওয়া যায় কোনো না কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট স্টেশন।
সিঙ্গাপুরের সব পাবলিক বাসে আছে হুইলচেয়ার ও স্ট্রলার নেয়ার ব্যবস্থা।
এসব কারণে সেখানকার ৯২ শতাংশ মানুষ তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের প্রশংসা করেছেন।
৭. হংকং
চীনের হংকং শহর পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য প্রায়ই সেরা বলে বিবেচিত হয়। এর কারণও আছে।
এখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক বেশ বিস্তৃত। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো, শহরটির ৭৫ শতাংশ মানুষের আবাসস্থলের মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো না কোনো মেট্রো স্টেশন আছে।
এই মেট্রোগুলো দক্ষহাতে পরিচালিত, বেশ পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক। এটি ব্যবহারের জন্য আছে অক্টোপাস কার্ড; অনায়াসেই এই কার্ড দিয়ে ভাড়া মেটানো যায়।
তবে এখানকার মেট্রো ব্যবহারে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। একবার মানিয়ে নিলে চলাফেরা একদম সহজ হয়ে যায়। ৯২ শতাংশ মানুষ তাই হংকংকে ভোট দিয়েছেন।
৮. তাইপেই
তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেই বিশ্বের অন্যতম একটি বাসযোগ্য শহর। এখানকার বিস্ময়কর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম এর একটি বড় কারণ।
দ্য তাইপেই মেট্রো বা এমআরটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত লাইট-রেল সিস্টেম। এত যাত্রী চাপ থাকার পরেও দক্ষতায় কোনো ত্রুটি নেই।
এলিভেটেড মেট্রোস্টেশন থেকে যাত্রীরা রাস্তার অভূতপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
৯২ শতাংশ বাসিন্দা তাই তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে গর্বিত।
৯. সাংহাই
মেট্রো স্টেশনের সংখ্যার দিক থেকে নিউ ইয়র্কের পরে চীনের সাংহাই শহরের অবস্থান। এখানকার মেট্রো লাইন অনেক বেশি বিস্তৃত। সে হিসেবে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেট্রোলাইন বলা হয়ে থাকে।
সাংহাইয়ের সাবওয়ে সিস্টেম অনেকটা নিউ ইয়র্কের আদলে করা। তবে এটি একদম সময়মতো চলে, যা অ্যামেরিকায় ঘটে না।
এখানে ট্রেনের পাশাপাশি বাস, ম্যাগলেভ, ট্যাক্সি ও ফেরিতে চড়া যায় সাংহাই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কার্ড দিয়ে।
শহরের ৯১ শতাংশ বাসিন্দা এই সিস্টেমকে সহজ বলে মনে করেন।
১০. অ্যামস্টেরডাম
নেদারল্যান্ডের এই শহরে গেলে হরহামেশা রাস্তায় দেখা যায় বাইসাইকেল। শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেরই অংশ এসব বাইসাইকেল। এর সঙ্গে ট্রেন, ট্রাম, ফেরি ও বাস তো আছেই।
সবগুলোই বেশ সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী। এ কারণে ৯১ শতাংশ মানুষ অ্যামস্টেরডামের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের পক্ষে মত দিয়েছেন।
১১. লন্ডন
অভিজাত লন্ডনের বাস, ট্রেন ও আন্ডারগ্রাউন্ড অনায়াসে ব্যবহার করার মতো। বেশ দক্ষ ও আইকনিকও।
সবচেয়ে বেশি চর্চা হয় এখানকার আন্ডারগ্রাউন্ডের। বহু সিনেমা বা টিভি শো-এর শুটিং হয়েছে সেখানে। সাধারণ মানুষের পছন্দের তালিকায় উজ্জ্বল লাল রংয়ের ডাবল ডেকার বাসও রয়েছে। সব মিলিয়ে ৯১ শতাংশ মানুষ তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমকে পছন্দ করেন।
১২. মাদ্রিদ
ইউরোপের অন্যতম বিস্তৃত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম রয়েছে স্পেইনের মাদ্রিদে। সেখানকার ৮৯ শতাংশ মানুষের বাড়ি থেকে স্টেশনের দূরত্ব এক কিলোমিটারের মধ্যে।
এই শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মধ্যে আছে মেট্রো, লাইট রেল, বাস ও ট্রেন। বিভিন্ন মেয়াদের টিকিট সেখানে কিনতে পাওয়া যায়।
শহরের ৮৯ শতাংশ বাসিন্দা এই সিস্টেমের ভক্ত।
১৩. এডিনবার্গ
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবার্গ হেঁটে চলাফেরার জন্য বেশ আরামদায়ক। এখানে পাবলিক বাস অনায়াসে পাওয়া যায়।
ট্রামগুলো দেখতে নর্থ ব্রিটেইনেরগুলোর মতো অতটা আইকনিক না হলেও ব্যবহারের জন্য বেশ কাজের।
ট্রান্সপোর্ট ফর এডিনবার্গ কার্ড অ্যাপ ইনস্টল করে সহজেই ব্যবহার করা যাবে এখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট।
১৪. প্যারিস
এ শহরের আইকনিক সিম্বল হলো এর মেট্রো। ইউরোপের দ্বিতীয় ব্যস্ততম সাবওয়ে সিস্টেমটি এখানে। ১৬টি লাইনে ৩০০ স্টেশনজুড়ে চলে এখানকার সাবওয়ে।
দেয়ালজুড়ে দারুণ চিত্রকর্ম স্টেশনগুলোকে দর্শনীয় স্থান করে তুলেছে।
সাবওয়ের পাশাপাশি বাস, ট্রাম ও আঞ্চলিক ট্রেনও এখানে বেশ চলে। ৮৪ শতাংশ মানুষ প্যারিসের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের পক্ষে বলেছেন।
১৫. নিউ ইয়র্ক
পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে কিছুটা পিছিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে সাবওয়ে প্রায়ই পৌঁছায় না- নিউ ইয়র্কের বাসিন্দাদের কাছে এটা তেমন অস্বাভাবিক বিষয়ও নয়।
তারপরও নিউ ইয়র্কে যাতায়াতের জন্য এই পাবলিক ট্রান্সপোর্টই একমাত্র সহজ উপায়। স্টেশনের সংখ্যার দিক থেকে এখানকার সাবওয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড়।
পাবলিক বাসও এই শহরে বেশ চলে। ৮৩ শতাংশ বাসিন্দা এই পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে ব্যবহারযোগ্য মনে করেন।
১৬. মনট্রেয়াল
ক্যানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরে ঘুরে বেড়ানো বেশ আনন্দদায়ক। হেঁটেও বেড়ানো যায় আবার সহজেই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যায়।
এর মধ্যে আছে বাস ও রাবার-হুইলের মেট্রো। বিভিন্ন মেয়াদের টিকিট এখানে কিনতে পাওয়া যায়। আর ১১ বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য টিকিটই লাগে না।
এই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমকে পছন্দ করেন ৮৩ শতাংশ বাসিন্দা।
১৭. শিকাগো
শিকাগোর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম নিখুঁত নয়। তারপরও শিকাগো ট্রানজিট কর্তৃপক্ষ তাদের আটটি ট্রেনলাইন ও ১২৯টি বাস পরিচালনায় বেশ শ্রম দেন।
৮২ শতাংশ বাসিন্দা তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন।
১৮. বেইজিং
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির এই শহরে যাতায়াতের জনপ্রিয় মাধ্যম হলো সাবওয়ে। ৫০০ মাইলেরও বেশি এরিয়াজুড়ে বিস্তৃত সাবওয়ে ট্র্যাকে ২৭টি লাইন ও ৫০০ স্টেশন আছে।
এর পাশাপাশি শহরে চলে বাস, ট্রলিবাস ও ট্রেন। ৮১ শতাংশ বাসিন্দা জানান, তারা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে অনায়াসেই চড়েন।
১৯. মুম্বাই
ভারতের এই মেট্রোপলিটনে সবচেয়ে জনপ্রিয় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হলো লোকাল ট্রেন। দারুণ সব অভিজ্ঞতা মিলবে ট্রেনগুলোতে। তবে ব্যস্ত সময়ে এটি এড়িয়ে চলাই ভালো।
ট্রেনের পাশাপাশি বাসিন্দারা বাস, রিকশা, মেট্রো ও ট্যাক্সিও নিয়মিত ব্যবহার করেন।
৮১ শতাংশ বাসিন্দা জানিয়েছেন, তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বেশ সুবিধাজনক।