লেখক মিলান কুন্ডেরার প্রয়াণ

টিবিএন ডেস্ক

জুলাই ১২ ২০২৩, ১৮:৫১

চলে গেলেন ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ লেখক মিলান কুন্ডেরা। ছবি: সংগৃহীত

চলে গেলেন ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ লেখক মিলান কুন্ডেরা। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

চেক বংশোদ্ভূত ফ্রেঞ্চ লেখক মিলান কুন্ডেরা মারা গেছেন। প্যারিসে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে মঙ্গলবার তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বুধবার চেক টেলিভিশন জানিয়েছে, কুন্ডেরার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।

ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী, অনুভূতি ও বিশ্বাস, যৌনতা ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে লেখা উপন্যাসের জন্য বিখ্যাত ছিলেন কুন্ডেরা। জিতেছেন পৃথিবীখ্যাত বিভিন্ন পুরস্কার।

চেকস্লোভাকিয়ার বার্নোতে ১৯২৯ সালের ১ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন কুন্ডেরা। ধীরে ধীরে চেক সংস্কৃতির প্রেমে পরেন তিনি। তবে লেখক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশে চেক সংস্কৃতির পাশাপাশি সমাজতন্ত্রও সমানভাবে প্রভাব রেখেছে।

তার অনবদ্য মহাকাব্য, ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’-এ তিনি প্রাগের বসন্তের পটভূমিতে ত্রিভুজ প্রেমের গল্প বলেছিলেন। এই মহাকাব্য ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর কুন্ডেরা পরিণত হন আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক তারকায়।

তবে নিজ জন্মস্থানে বিতর্কিত লেখা প্রকাশের দায়ে ১৯৭৮ সালে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। একই সঙ্গে সোভিয়েত সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার কুন্ডেরার চেকস্লোভাকিয়ার নাগরিকত্ব বাতিল করে।

এরপর থেকে দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত নির্বাসিত লেখক হিসেবে পরিচতি পান ভিন্ন মতাদর্শের এই চেক ঔপন্যাসিক। তিনি দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রায় এক দশক ফ্রান্সের প্যারিসে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন।

চেকস্লোভাকিয়ায় ভেলভেট রিভল্যুশনে আয়রন কার্টেনের পতনে সৃষ্টি হয় চেক রিপাবলিক। তবে এই লেখক আর কখনও নিজ দেশে ফিরে যাননি। জার্মান সাপ্তাহিক ডাই জেইটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কুন্ডেরা বলেছিলেন, ‘আমার আর প্রাগে ফিরে যাওয়ার কোনো স্বপ্ন নেই। আমার শহরকে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। প্রাগের গন্ধ, স্বাদ, ভাষা, প্রকৃতি, সংস্কৃতি…।’

কুন্ডেরার উপন্যাসগুলো ১৯৯০ এর দশক থেকে চেক ভাষায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। তবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তার মহাকাব্য ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ চেক রিপাবলিকে প্রকাশিত হয়নি।

কুন্ডেরার জীবন

হাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কুন্ডেরা ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তবে বছর দুয়েক পরেই ‘প্রতিকূল চিন্তাভাবনা ও ব্যক্তিবাদী প্রবণতার’ কারণে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ফলে ফিল্ম অ্যাকাডেমির ছাত্রত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন কুন্ডেলা।

তিনি ১৯৫৩ সালে ‘ম্যান: আ ওয়াইড গার্ডেন’ নামের কবিতা সংকলনের মাধ্যমে লেখক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। ছন্দে ছন্দে তিনি কমিউনিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদদের সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন।

এরপর তিনি ফের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তবে বেশিদিন টিকতে না পেরে আবারও বহিষ্কৃত হন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার ছিল টক-মিষ্টির মতো সম্পর্ক।

তবে প্রথম প্রকাশনীর পর আর পেছন ফিরে তাকাননি কুন্ডেরা। তার প্রথম হাস্যরসাত্মক গল্পের উপন্যাস ‘দ্য জোক’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়।

প্রাগে বসন্তে সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে নিষিদ্ধ করে কমিউনিজম। তাকে ১৯৬৯ সালে রাইটার্স কমিউনিটি থেকে ও ১৯৭০ সালে পার্টি থেকে আবার বহিষ্কার করা হয়। একই সঙ্গে তার রচিত নাটক সংগ্রহশালা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়, তার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয় ও বাজার থেকে তার লেখা সব ধরনের বই বাজেয়াপ্ত করা হয়।

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও লেখা চালিয়ে যান কুন্ডেরা। ‘লাইফ ইজ এলসহয়্যার’ ও ‘দ্য ফেয়ারওয়েল ওয়াল্টয’ যার প্রথম শিরোনাম ছিল ‘দ্য ফেয়ারওয়েল পার্টি’ বই দুটিতে কমিউনিস্ট পার্টির অতীত তুলে ধরেন তিনি।

কুন্ডেরা জানতেন তার লেখাগুলো চেকস্লোভাকিয়ায় প্রকাশিত হবে না। তবে সেই দায়িত্ব পালন করে ফ্রান্স। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত কুন্ডেরাকে ১৯৭৫ সালে আশ্রয় দেয় প্যারিস। পরে তিনি ফ্রান্সে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

নির্বাসিত জীবনে লেখনিকে শক্তিতে পরিণত করেন কুন্ডেরা। চেকস্লোভাকিয়ার পটভূমিকে ব্যবহার করে ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করেন ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’। তার ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ ১৯৮৪ সালে বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান করে নেয়।

পরবর্তীতে জুলিয়েট বিনোচ ও ড্যানিয়েল ডে লুইস উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রদের সফল রুপায়নের মাধ্যমে সেটিকে একটি সফল চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেন।

এরপর একে একে সময়োপযোগী আরও অনেক বই প্রকাশ করেন এই আন্তর্জাতিক তারকা লেখক। তার লেখা ‘ইম্মরালিটি’ ১৯৯০ সালে প্রকাশের পর আবারও সবার মনোযোগ কাড়ে। তবে পরবর্তী লেখাগুলো অতটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।

অবশ্য কিছু সাহিত্য সমালোচক তার এই উপন্যাসগুলোকে দার্শনিকতায় দক্ষ ও প্রাবন্ধিক মাধুর্যতা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অন্যরা এই লেখককে একজন অগ্রগামী নৈতিকতাবাদী, পশ্চিম ইউরোপীয় সভ্যতা এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদের সমালোচক হিসেবে প্রশংসা করেছেন।

এক দশকেরও বেশি সময়ের বিরতির পর ২০১৪ সালে ‘দ্য ফেস্টিভ্যাল অফ ইনসিগনিফিকেন্স’ নামের নতুন উপন্যাস নিয়ে হাজির হন কুন্ডেলা। তার এই মাস্টারপিস ইউরোপ জুড়ে প্রশংসা কুড়ালেও ভেদাভেদ ছিল সমালোচকদের সমালোচনায়।

কেউ বলেন তার অনবদ্য লেখনি তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে চার বন্ধুর পটভূমিতে রচিত উপন্যাসটি। আবার কেউ বলেছেন, এটি বার্ধক্যের অপরিপক্ক লেখা। অনেকে আবার ‘দ্য ফেস্টিভ্যাল অফ ইনসিগনিফিকেন্স’কে তুলনা করেছেন ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ এর মূল থিমের সঙ্গে। একই ঘরনার এই উপন্যাস সমালোচিত হলেও বেস্ট সেলার তালিকায় ব্যবসা সফল।

নির্বাসিত কুন্ডেরা এক সময় চেক রিপাবলিকের সঙ্গে তার অতীত সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করা বন্ধ করে দেন। নাগরিকত্ব না থাকলেও ১৯৯৬ সালে নির্বাসিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো চেক রিপাবলিকে যান তিনি। এরপর আরও কয়েকবার তার জন্মভূমিতে যাওয়ার খবর প্রকাশ্যে এলেও কোনো প্রমাণ মেলেনি।

তবে তার ভক্ত অনুরাগীদের মনে আশা বাড়তে থাকে। প্রিয় লেখককে সামনে থেকে দেখে, অটোগ্রাফ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন অনেকেই। আশা করা হয় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে শিগগিরই লেখক জন্মভূমিতে ফিরে যাবেন। তার পুনর্মিলনীকে স্মরণীয় করতে সাবেক চেক প্রধানমন্ত্রী অ্যান্দ্রেজ বাবিস ২০১৯ সালে কুন্ডেরাকে চেক নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেন।


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন