
রাশিয়া থেকে ভারত: প্রত্যন্ত গুহায় যেমন ছিল কুতিনার জীবন

টিবিএন ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৩ ২০২৫, ২০:৫২ হালনাগাদ: নভেম্বর ১৩ ২০২৫, ১:১১

দুই মেয়ের সঙ্গে নিনা কুতিনা। ছবি: গালফ নিউজ
- 0
সুদূর ইউরোপ থেকে ভারতের প্রত্যন্ত একটি গুহায় রুশ নারীর আট বছর কাটানোর এ কাহিনি তুলে ধরেছে গালফ নিউজ। নিনা কুতিনা ওরফে মোহির বয়স ৪০ বছর বলে জানায় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি। তার দুই মেয়েরই জন্ম ভারতে।
গল্পটা চলচ্চিত্রের নয়, কিন্তু এর ভাঁজে ভাঁজে ফিল্মি ছোঁয়া। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিনা কুতিনা, যার আরেক নাম মোহি। তার আছে দুটি কন্যা।
সালটা ২০১৬। স্বল্পমেয়াদি ভিসায় বেড়াতে ভারতে আসেন কুতিনা। সেখানে সনাতন ধর্মে আবিষ্ট হয়ে পড়েন এ নারী।
এ ভক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ভারতেই বসতি গড়ার সিদ্ধান্ত নেন কুতিনা, কিন্তু তার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভিসার মেয়াদ। সেটাও কাটিয়ে ভারতে থাকার পদ্ধতি বের করে ফেলেন তিনি।
সুদূর ইউরোপ থেকে ভারতের প্রত্যন্ত একটি গুহায় রুশ নারীর আট বছর কাটানোর এ কাহিনি তুলে ধরেছে গালফ নিউজ। নিনা কুতিনা ওরফে মোহির বয়স ৪০ বছর বলে জানায় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি। তার দুই মেয়েরই জন্ম ভারতে।
এ দুই কন্যাকে নিয়ে দক্ষিণপশ্চিম ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের উত্তরা কন্নড়া জেলায় থাকতেন কুতিনা। গোকর্ণ শহরের কাছে রামতীর্থ পাহাড়ের ঢালে বনাঞ্চলের গুহাটিতে ছিল তাদের বাস। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আট বছরের বেশি সময় নিভৃতে ছিলেন তিনি।
প্রায় বিচ্ছিন্ন দুই মাস
বনাঞ্চলে তিন সদস্যের পরিবারটির খোঁজ পান পুলিশ সদস্যরা। গত দুই মাস ধরে কুতিনা এবং তার ছয় ও চার বছর বয়সী দুই সন্তান ছিলেন প্রায় বিচ্ছিন্ন। এ সময়ে প্রকৃতিই ছিল তাদের আশ্রয় ও টিকে থাকার মাধ্যম। বনের আড়ালে কুতিনার ভারত জীবনের সঙ্গী হয় দুই কন্যা, কিন্তু শিশুদের বাবার বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে তিনি বরাবরই নারাজ ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জঙ্গলে বসতি: নুডলসে ক্ষুন্নিবৃত্তি ও ধ্যান
রামতীর্থ পাহাড়ের ঢাল এলাকাটি ভূমিধসপ্রবণ। সেখানকার ঘন সবুজ অরণ্যের গহীনের গুহাটি হয়ে উঠেছিল কুতিনাদের অভয়ারণ্য। এর ভেতরে ছিল রুদ্রের এক মূর্তি, রুশ ভাষার কিছু বই ও হিন্দু দেব-দেবীর ছবি।
রোজই ধর্মীয় আচার পালন করতেন মোহি নামধারী রুশ নারী। সন্তানদের শেখাতেন যোগব্যায়াম ও ধ্যান। তিনি অনুসরণ করতেন এক রুটিন, যার মধ্যে ছিল ছবি আঁকা, গান গাওয়া ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা।
গুহাটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী রাখতেন কুতিনা। সামান্য খেয়ে, পরে জীবন কাটাতেন তিনি ও সন্তানরা। তাদের খাবারের মধ্যে ইনস্ট্যান্ট নুডলসও ছিল বলে খবর পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পরিবারটি ঘুমাত প্লাস্টিক শিটে। মোমবাতির পরিবর্তে তারা ব্যবহার করত প্রাকৃতিক আলো। বর্ষার মৌসুমেও একই ধরনের জামা পরত তারা। এভাবেই বনের সঙ্গে বেঁধে যায় তাদের প্রাণ।
যেভাবে পরিবারটির সন্ধান
গত ৯ জুলাই কর্ণাটকের বনাঞ্চলটিতে টহলে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। সে সময় গুহার কাছে শাড়ি ও প্লাস্টিকের আবরণ দেখতে পান তারা। এর জের ধরে গুহাটিতে গিয়ে এক নারী ও দুই সন্তানকে স্বাভাবিক অবস্থায় বসবাস করতে দেখে বিস্ময় জাগে তাদের।
কুতিনাদের বসবাসের এলাকাটি বিষধর সাপ ও অন্য বন্যপ্রাণীদের জন্য পরিচিত, কিন্তু সাপ নিয়ে বিচলিত মনে হয়নি দুই সন্তানের জননীকে। পুলিশকে শান্ত স্বরে তিনি জানান, সাপ তাদের বন্ধু। সাপের ক্ষতি না করলে সাপও তাদের ক্ষতি করবে না।
তিনি জানান, ঝরনায় তাদের গোসলের সময় প্রায়ই পাশ দিয়ে যেত সাপ, কিন্তু কখনও তার মনে জাগেনি ভয়।
বিতাড়নের শঙ্কায় বনে
বিজনেস ভিসায় ২০১৬ সালে ভারতে আসেন কুতিনা। শুরুতে গোয়ার আকর্ষণীয় গন্তব্যগুলো ঘুরে দেখেন তিনি। এর কিছুদিনের মধ্যে সনাতন ধর্মের প্রতি ঝুঁকে যান তিনি। এরপর কর্ণাটকের উপকূলীয় পবিত্র শহর হিসেবে পরিচিত গোকর্ণে আশ্রয় নেন এ নারী।
কুতিনার ভিসার মেয়াদ শেষ হয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে। তবুও তিনি ছাড়তে চাননি ভারত, কিন্তু তার ছিল না বৈধতা।
দুই সন্তানসহ রুশ নারীকে উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন পুলিশের উপপরিদর্শক শ্রীধর এস.আর। তিনি দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, হোটেল কিংবা জনাকীর্ণ এলাকায় থাকতে গেলে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ার শঙ্কা ছিল তার। এ কারণে নির্জন বনকেই বাড়ি বানিয়ে ফেলেন তিনি।
আইনি ব্যবস্থা ও বিতাড়ন প্রক্রিয়া
কুতিনা ও তার সন্তানদের রাশিয়ায় বিতাড়নের আইনি প্রক্রিয়া চালাচ্ছে ভারত। এরই মধ্যে তাদের উইমেন’স রিসিপশন সেন্টারের অধীনে রাখা হয়েছে।
বেঙ্গালুরুর শান্তিনগরে সোমবার ফরেইনার্স রেজিয়নাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে কুতিনা ও তার কন্যাদের হাজির করা হবে। পুরো প্রক্রিয়াটির দেখভাল করবেন একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা।
বিতাড়নের প্রক্রিয়ায় থাকা রুশ নারীর ভারতে থাকা অনিশ্চিত, তবে তার আট বছরের এ আত্মিক ও আধ্যাত্মিক যাত্রা নাড়া দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সাধারণ জনগণকে।