মণিপুর নিয়ে ভারতের দায় এড়ানোর চেষ্টা

প্যাট্রিসিয়া মুখহিম

জুলাই ২৩ ২০২৩, ১০:৪২

মণিপুরে চলছে জাতিগত সংঘাত। ছবি: সংগৃহীত

মণিপুরে চলছে জাতিগত সংঘাত। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে গত ৩ মে থেকে মেইতি ও কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষের আগুন জ্বলছে।

মেইতিরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ এবং কুকি-জো সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্যান্য উপজাতি মিলিতভাকে জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ।

মণিপুরে গত ১৮ জুলাই দুই নারীকে নগ্ন করে পেটানোর একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরই জাতিগত সহিংসতার দিকে ভারত ও গোটা বিশ্বের নজর পড়েছে। এ ঘটনায় অন্তত একজন নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

মনিপুর দাঙ্গায় ভারতের বেশিরভাগ মানুষের জেগে উঠতে সময় লেগেছে ৭৮ দিন।

সংঘর্ষের তাৎক্ষণিক সূত্রপাত ঘটে একটি আদালতের আদেশ থেকে। এই আদেশের মাধ্যমে কুকিদের মতো উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য জমির অধিকার এবং অন্যান্য সুবিধাগুলো বাড়ানো হয়েছে, তবে এতে মেইতিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

এরপর সহিংসতায় ১৪৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন, হাজার হাজার আদিবাসী গৃহহীন হয়ে পড়েছে এবং প্রায় ৬০,০০০ কুকি-জো এখন মিজোরাম, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরায় শরণার্থী। এটি একটি মানবিক সংকট এবং একটি গৃহযুদ্ধ যেখানে নারীদের জবরদস্তি ও পরাধীনতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

মণিপুরে আগুন অনেক আগেই জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল। এখন সেই শিখাটিকে এমন এক রাজনীতি বাঁচিয়ে রেখেছে যা মণিপুরীদের মাঝে বিভেদ ও রাজ্যের সংহতি গুড়িয়ে দিয়েছে।

মণিপুরে বন্দুক ও বোমা মানুষের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। এমনকি ১৯৮০ এর দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী ধর্ষণকে পরাধীনতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

ভারত স্বাধীন হওয়ার চার দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট মণিপুরের রাজা বোধচন্দ্র সিং ভারত সরকারের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির চুক্তি করেন। এই চুক্তি নিয়ে মেইতি সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।

চুক্তিটি ছিল মেইতি রাজা মণিপুরে শাসন চালিয়ে যাবেন, তবে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় এবং যোগাযোগের দিকগুলো ভারতীয় কতৃর্পক্ষের কাছে হস্তান্তর করবেন। বাস্তবে ১৯৭২ সালের মধ্যে মণিপুর অন্য যেকোনো রাজ্যের মতো ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।

মণিপুরের আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে মেইতি, কুকি এবং নাগা। ব্রিটিশরা ভাগ করার সময় মণিপুরকে পাহাড় ও উপত্যকায় বিভক্ত করেছিল। প্রধানত খ্রিষ্টান উপজাতিরা (নাগা ও কুকি-জো) পাহাড়ে সীমাবদ্ধ ছিল এবং বেশিরভাগ হিন্দু মেইতি ইম্ফল উপত্যকায় ছিল। তবে পাহাড়গুলো রাজ্যের ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এবং উপত্যকাটি রয়েছে ১০ শতাংশ অঞ্চলের মধ্যে।

স্বাধীন ভারতের উচিত ছিল ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া। তা না করে মেইতিদের পাহাড়ে জমি কেনার অনুমতি দেয়া হয়নি, তবে উপজাতিরা উপত্যকায় জমি কিনতে পারে। এ ঘটনা মেইতি জনগোষ্ঠীর উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার পরিবর্তে, নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার বৃটিশদের তৈরি করা বিভাজনকে চিরস্থায়ী করেছে। এই ফাটল এখন পাহাড়ের উপজাতি এবং উপত্যকার মেইতিদের মধ্যে আপাতদৃষ্টি অপূরণীয় ফারাক তৈরি করেছে।

কুকিদের বিরুদ্ধে জেনোফোবিয়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যদিও তারা মণিপুরের আদিবাসী, তবু ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং একটি নতুন আখ্যান তৈরি করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের চিন পাহাড় থেকে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে কুকিরা ক্রমাগত প্রবেশ করছে এবং এর ফলে জমি ও অন্যান্য সম্পদের উপর চাপ বাড়ছে।

সিং একজন মেইতি এবং তাকে ব্যাপকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করতে দেখা গেছে। কুকি-জো জনসংখ্যার দিক থেকে হঠাৎ যদি বেড়েও থাকে সেটি প্রমাণ করার একমাত্র উপায় হলো পরিসংখ্যান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার এমনকি বিজেপিও ২০২১ সালে নির্ধারিত ভারতের দশকীয় আদমশুমারি শেষ করেনি। তাই কুকি অনুপ্রবেশের অভিযোগ অপ্রমাণিত রয়ে গেছে।

মণিপুর যা দেখছে তা একদিক থেকে সমগ্র ভারতের দুর্দশার প্রতিফলন। নাগরিকদের জানমাল রক্ষার পরিবর্তে একের পর এক রাজ্যে পুলিশ কীভাবে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কাজ করছে তার উদাহরণ হচ্ছে এসব ঘটনা।

এটি ১৮৬১ সালের ভারতীয় পুলিশ আইনের ব্যবহারের ফলে সম্ভব হচ্ছে, যা একটি ঔপনিবেশিক আইন। এ আইন বৃটিশদের ভারতীয়দের দমন করতে সহায়তা করেছিল। মণিপুরের পুলিশ ইম্ফল উপত্যকার কুকি-জো জনগোষ্ঠীর জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর কারণ হল তারা বর্তমান সরকারের কাছ থেকে তাদের আদেশ গ্রহণ করে এবং সংবিধান অনুযায়ী কাজ করছে না, যেখানে বলা হয়েছে যে সমস্ত নাগরিক সমান।

তবু মণিপুর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভারতের বাকি অংশ থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। কয়েক দশক ধরে একে সেভাবেই দেখানো হয়েছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলটি মূলত তিব্বতি-বর্মী এবং অস্ট্রোএশিয়াটিক গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে পরিচিত।

উত্তর-পূর্বাঞ্চল বহু প্রজন্ম ধরে লাগামহীন জাতিবাদের শিকার হয়েছে। শারীরিক সহিংসতা এবং যৌনতাসহ- ভারতের বাকি অংশের কাছে তারা আজীবন অন্য চোখে ছিল। একই সময়ে এই অঞ্চলের চ্যালেঞ্জ এবং সাহায্যের জন্য আর্তনাদগুলো নয়াদিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু এবং চেন্নাইয়ের ক্ষমতা এবং মিডিয়া চ্যানেলগুলোর ভিড়ে নিয়মিত উপেক্ষিত হচ্ছে।

তথাকথিত জাতীয় মিডিয়া যখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে তাকায় তখনই চাঞ্চল্যকর খবর আসে। যেমন নারীদের নগ্ন করে হাঁটানোর সাম্প্রতিক ভাইরাল ভিডিও। আর সেই ভিডিওর জেরেই মণিপুরের সংকট নিয়ে দুই মাসেরও বেশি সময় পর নীরবতা ভাঙলেন মোদী। ভিডিওতে দেখানো ভয়াবহতার নিন্দা জানালেও প্রধানমন্ত্রী মে মাসের গোড়া থেকে শুরু হওয়া সংঘাত সম্পর্কে একটি শব্দও বলেননি।

এটা দিয়ে আমরা কী বুঝব? মণিপুর যদি বিরোধীশাসিত রাজ্য হতো তাহলে মোদি সেই বিরোধী সরকারের জন্য বিভীষিকা ডেকে আনতেন।

আজকের ভারতের পরিস্থিতি এটাই। যারা কষ্ট ভোগ করে তাদের অবশ্যই নিজের কান্না মুছতে শিখতে হবে। নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে এবং সাহায্যের জন্য রাষ্ট্রের দিকে তাকানো বন্ধ করতে হবে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ যদি ভারতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে কেন তাদের দোষারোপ করা হবে? আশা ও প্রত্যাশার মধ্যে সাত দশকেরও বেশি সময় আগে স্বাক্ষরিত ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশনের দিকে যদি তারা ফিরে তাকায়, তাহলে কেন তাদের দোষারোপ করা হবে?

কারণ ভারত সরকার তাদের আশার সঙ্গে চুক্তিকেও ছুড়ে ফেলেছে।

[প্যাট্রিসিয়া মুখহিম দ্য শিলং টাইমসের সম্পাদক এবং অধিকারকর্মী]


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন