‘পুতিনের শেফ’ থেকে ভাগনারপ্রধান প্রিগোযিন

টিবিএন ডেস্ক

জুন ২৫ ২০২৩, ১৬:৫৩

ভাগনার বাহিনীপ্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোযিন। ছবি: সংগৃহীত

ভাগনার বাহিনীপ্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোযিন। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

রাশিয়ার বেসরকারি সামরিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোযিন রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়ার পর থেকে দৃশ্যপটে উঠে এসেছেন।

ইউক্রেইন যুদ্ধে রাশিয়ার নিয়মিত সৈন্যরা যখন ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন এবং এলাকার দখল হারাচ্ছিল তখন প্রিগোযিনের ভাড়াটে সেনারা মস্কোর হয়ে যুদ্ধ শুরু করে

দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে ইউক্রেইনের দক্ষিণের বাখমুত শহরে ভাগনারের সৈন্যরা রাশিয়ার পতাকা ওড়ায়। প্রায় ১৫ মাস যুদ্ধের পরে তারা রাশিয়াকে এ জয় এনে দেয়।

প্রিগোযিন বাখমুত বিজয়কে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি ইউক্রেইনে ব্যার্থতার জন্য শীর্ষস্থানীয় রাশিয়ান সামরিক ব্যাক্তিদেরকে দায়ী করেন। অল্প কিছু মানুষই আছেন যারা ক্রেমলিনের ক্রোধ এড়িয়ে এমন কথা বলতে পারেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চলমান বিবাদ শনিবার আরও তুঙ্গে ওঠে। ভাগনার প্রধান জানান, তার সৈন্যরা ইউক্রেইন বর্ডার ছেড়ে রাশিয়ান বর্ডার শহর রুস্তভ-অন-ডনে প্রবেশ করছে। এ সময় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয় কেউ থামানোর চেষ্টা করলে তারা লড়াইয়ে প্রস্তুত।

এর পর দেশটির কয়েকটি প্রধান শহর দখলে নেয় বাহিনীটি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভাগনারকে ‘বিশ্বাসঘাতক’হিসেবে অভিহিত করার পর তাকে উপহাস করেন প্রিগোযিন।

ভাগনারের টেলিগ্রাম চ্যানেলে শনিবার পোস্ট করা এক বার্তায় বলা হয়েছে, ‘পুতিন ভুল করেছেন। তিনি নিজের জন্যই বিপদ ডেকে এনেছেন। খুব শিগগিরই আমরা নতুন প্রেসিডেন্ট পাব।’

ভাগনার প্রধান রাশিয়ার ইউক্রেইনকে আক্রমণের কারণও ক্রেমলিনের কাছে জানতে চায়।

প্রিগোযিন টেলিগ্রামে শুক্রবার প্রকাশিত একটি ভিডিও ক্লিপে বলেন, ‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জনগণ এবং প্রেসিডেন্টকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে। তারা আমাদেরকে একটি গল্প শোনাচ্ছে কীভাবে ইউক্রেন থেকে তুমুল আগ্রাসন শুরু হয়েছিল এবং তারা ন্যাটোর সঙ্গে আমাদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল।’

জরুরি এক টেলিভিশন ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ভাগনারের ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’ রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল এবং কেউ রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলে তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।

প্রিগোযিন ইউক্রেনে ওয়াগনারের ফিল্ড ক্যাম্পে রকেট হামলার নির্দেশ দেয়ার জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে অভিযুক্ত করেন। এতে ভাগনার বিপুলসংখ্যক যোদ্ধা হারায়। অভিযোগের আঙুল তোলার একদিন পরেই তাদের পক্ষ থেকে উস্কানি আসে।

প্রিগোযিনের উত্থান

প্রিগোযিন ১৯৮১ সালে ডাকাতি এবং হামলার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়ে ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। মুক্তির পর ১৯৯০ এর দশকে সেইন্ট পিটার্সবার্গে একটি রেস্তোরাঁ ব্যবসা খোলেন তিনি।

সে সময় সেইন্ট পিটার্সবার্গের ডেপুটি মেয়র ছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন ও প্রিগোযিনের পরিচয় সে সময় থেকেই।

এই পরিচিতি দিয়ে প্রিগোযিন একটি ক্যাটারিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করেন। পুতিনের ঘনিষ্ঠতায় রাশিয়ান বেশ কিছু সরকারি দরপত্রও জেতেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি ‘পুতিনের শেফ’ হিসেবে পরিচিতি পান। পরবর্তীতে মিডিয়া এবং ইন্টারনেটে ট্রল ফার্ম ব্যবহার করে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেন বলে অ্যামেরিকা অভিযোগ করে।

প্রিগোযিন জানুয়ারিতে ভাগনার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, নেতৃত্ব এবং অর্থায়ন করার কথা স্বীকার করেন।

প্রিগোযিনের মতে কোম্পানির সেরা সময়ে ৫০ হাজার লোকবল ছিল। এর মধ্যে ৩৫ হাজার যোদ্ধা সামনের সারিতে অবস্থান করতেন। তার লোকবল অপরাধী কিনা সে ব্যপারে তিনি কিছু না বললেও জানা যায় তিনি যোদ্ধাদের নিয়োগের জন্য রাশিয়ান কারাগারগুলোতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ভাগনারের হয়ে অর্ধ বছর সম্মুখ সারিতে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকলে ক্ষমার ব্যবস্থা করা হবে বলেও তিনি যোদ্ধাদের প্রতিশ্রুতি দেন।

প্রিগোযিনের প্রভাবের কারণ কী?

প্রিগোযিন ভয়ংকর চেহারার জন্য ব্যাপকভাবে সুপরিচিত। ক্ষতবিক্ষত মুখ, কামানো মাথা এবং তামাকের দাগযুক্ত দাঁতের সঙ্গে মারাত্মক বচনভঙ্গি তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।

এক জরিপে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট পুতিন, প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর পর প্রিগোযিন রাশিয়ায় পঞ্চম সর্বাধিক স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব।

তিনি রক্ষণশীল রাশিয়ানদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক স্থান তৈরি করেছেন। রক্ষণশীলরা সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনকে শ্রদ্ধা করে এবং যেকোনো মূল্যে ইউক্রেনের যুদ্ধে জয়ী হতে চায়।

প্রিগোযিন মে মাসে বলেছিলেন, ‘কমরেড স্তালিন একেবারেই সঠিক ছিলেন।’

যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে ‘ব্যর্থ’ সেনা ও কর্মকর্তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার হুমকিও দেন তিনি।

ইস্ট ইউক্রেইনে কয়েক হাজার ভাড়াটে সৈন্যের মৃত্যুর পর প্রিগোযিন বলেছিলেন, ভাগনার গ্রুপে আরও লোক নিয়োগ করতে হবে এবং আদর্শ একটি সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত করতে হবে।

রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফার্স্ট কমান্ডার দিমিত্রি উটকিনের ডাকনাম অনুসারে কোম্পানিটিকে ভাগনার বলে ডাকা হয়। ভাগনার শিগগিরই বর্বরতা ও নির্মমতার জন্য কুখ্যাতি লাভ করে।

রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এপ্রিল ২০১৪ সালে সেখানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাত শুরু হয়। তখন থেকেই ভাগনারকে ইস্ট ইউক্রেইনে প্রথম কাজ করতে দেখা যায়।

সিরিয়ায় যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন করে ভাগনার বাহিনী মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। লিবিয়ায় তারা বিদ্রোহী কমান্ডার খলিফা হাফতারের বাহিনীর হয়ে লড়াই করেছিল। বাহিনীটি সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও মালিতেও কাজ করছে বলে ধারণা করা হয়।

ভাগনারের মানবাধিকার লঙ্ঘন

পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ভাগনারের বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, লিবিয়া এবং মালিসহ আফ্রিকা জুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। একই সঙ্গে বাহিনীটিকে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইউক্রেনে ‘অস্থিতিশীল কার্যকলাপ’ চালানোর জন্য অভিযুক্ত করেছে।

এছাড়া বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে সাংবাদিকসহ নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করে মেরে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। রাশিয়া সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে ছিল নীরব।


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন