মাউই দাবানল: বাড়ছে মৃতের সংখ্যা, প্রশাসনে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা

টিবিএন ডেস্ক

আগস্ট ১৪ ২০২৩, ১৪:৩৬

দাবানলে পুড়ছে মাউই। ছবি: সংগৃহীত

দাবানলে পুড়ছে মাউই। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার হাওয়াইয়ের মূল পর্যটন স্পট ও সাবেক রাজকীয় রাজধানী লাহাইনা এখন যেন শ্মশান। চারদিকে কেবল ধ্বংসস্তুপ, ছাই, পোড়া গন্ধ আর শোক।

মাউই কাউন্টির এই জমজমাট শহর স্টেইটের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানলে পুড়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ছয় দিনে ধ্বংসস্তুপের কেবল ৩ শতাংশ এলাকায় উদ্ধারকাজ পুরোপুরি শেষ করা গেছে। তাতেই সোমবার সকাল পর্যন্ত ৯৬ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ কয়েকশ মানুষ। আর ঘরহারা কয়েক হাজার মানুষ।

এত সংখ্যক প্রাণহানির জন্য প্রশাসনের অবহেলাকে দুষছেন স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ, দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে জেনেও কোনো ধরনের সতর্কতা জারি করা হয়নি, বাজেনি সাইরেন।

দাবানল ঠিক কতটুকু ছড়ায়, মাউইয়ে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে- তা এখনও হিসাব করা যায়নি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তবে জানা গেছে, গত মঙ্গলবারের ওই দাবানল প্রতি মিনিটে এক মাইল বেগে লাহাইনায় ছড়াতে থাকে; বুধবার সকাল নাগাদ গোটা শহর ও আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

লাহাইনার প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে ছাই হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গভর্নর জশ গ্রিন গত ১০ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘হাওয়াই স্টেইটের ইতিহাসে সম্ভবত এটিই সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ।’

হোনোলুলুর ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসেসের (এনডব্লিউএস) আবহাওয়াবিদ রবার্ট বোহলিন বলেন, হাওয়াইয়ের বিগ আইল্যান্ডের কিছু দাবানলের পাশাপাশি বিধ্বংসী মাউইয়ের দাবানল আবহাওয়ার বিরূপ সংমিশ্রণের ফল। এর কারণগুলোর মধ্যে আছে, জোরাল বাতাস, শুষ্ক গাছপালা এবং কম আর্দ্রতা।

স্টেইটের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ, বিশেষত মাউই খরা পরিস্থিতি কারণে শুষ্ক হয়েছিল। বোহলিন বলেন, ‘এখন বছরের সেই সময়, যখন পরিবেশ শুকিয়ে যেতে শুরু করে।’

অ্যামেরিকা ড্রউট মনিটরের মতে, স্বাভাবিকের চেয়ে কম আর্দ্র বাতাসের কারণে এই শুষ্কতা আরও বেড়েছে। খরায় ঘাস এবং অন্য গাছপালা শুকিয়ে যায়, যার ফলে এগুলো দাবানলে জ্বালানি হিসেবে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে তীব্র বাতাস দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে।

শহরের বাসিন্দারা ইমার্জেন্সি রেসপন্সের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, সময়মতো সাইরেন বাজলে অনেকেই পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারতেন।

সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে লাহাইনাবাসী জানায়, মঙ্গলবার সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, বিদ্যুৎ নেই। তারা ধরে নেন, হারিকেন ডোরার কারণে হয়ত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। পুর্ব উপকূলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল।

শহরের প্রাণকেন্দ্রে বাড়ি ছিল ৪২ বছর বয়সী লেস মুনের। তিনি জানান, হ্যারিকেন ডোরার কারণে মাউইতে ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে দমকা হাওয়া বইতে পারে বলে সতর্ক করেছিল কর্তৃপক্ষ। জানিয়েছিল, ছোট ছোট দাবানলও সৃষ্টি হয়েছে।

তবে মঙ্গলবার সকাল ১০টা নাগাদ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, দাবানল পুরোপুরি নেভানো গেছে।

দুপুরের দিকে হঠাৎ তীব্র বাতাস আর পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে শহরে। কিছু ভবনের ফায়ার অ্যালার্মও বেজে ওঠে। দুপুর ৩টার দিকে আগুন বিভিন্ন ভবন গ্রাস করতে থাকে। যারা বাইরে রাস্তায় ছিলেন, তারা কোনোভাবে দৌঁড়ে এদিক-ওদিক আশ্রয় নেন।

৬৩ বছর বয়সী আরেক বাসিন্দা ভিলমা রিড বলেন, ‘আমাদের শহরের পেছনে পাহাড়ে আগুন জ্বলছিল, কেউ আমাদের কিছু বলেনি... আমি কখন বুঝলাম আগুন ছড়াচ্ছে জানেন? যখন আমার সামনের রাস্তায় আগুনের শিখা দেখতে পাই।’

প্রথম দফায় আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ারফাইটাররা রাস্তার পাশের ফায়ার হাইড্রেন্টে কোনো পানি পায়নি।

কেয়াহি হো নামের এক ফায়ারফাইটার বলেন, ‘কোনো হাইড্রেন্টে পানি ছিল না।’

সুনামি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাসিন্দাদের সতর্ক করতে হাওয়াইন এই দ্বীপে ৮০টি আউটডোর সাইরেন রয়েছে। সেগুলো প্রতি মাসে পরীক্ষা করা হয়। তবে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার দিন কোনোটিই বাজেনি।

হাওয়াই ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট অ্যাজেন্সির মুখপাত্র অ্যাডাম ওয়েনট্রাউব শনিবার নিশ্চিত করেছেন, সাইরেনগুলো সক্রিয় ছিল না। বেঁচে যাওয়া কয়েকজন জানিয়েছেন, তাদের মোবাইল ফোনে মঙ্গলবার সকাল সতর্কবার্তা এসেছিল। তবে শহরে বিদ্যুৎ না থাকায় বেশিরভাগ মানুষের মোবাইলে চার্জ ছিল না। তাই অনেকের কাছেই সেই বার্তা পৌঁছেনি।

সাইরেন না বাজার বিষয়টি স্বীকার করে হাওয়াইয়ের সেনেটের ম্যাজি হিরোনো জানান, স্টেইট অ্যাটর্নি জেনারেল ঘটনাটি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য আমি অপেক্ষা করছি.. তবে এটি এই ট্রাজেডির জন্য কোনো অজুহাত হিসেবে আমি দেখাব না... আমরা এখন উদ্ধারকাজকেই প্রাধান্য দিচ্ছি...।’

স্টেইট সরকারের অবহেলার কারণে আগুনে বাড়ি হারিয়েছেন জানিয়ে লিজ জেরম্যানস্কি বলেন, এত মৃত্যুর জন্য দায়ি প্রশাসনই।

তিনি বলেন, ‘এটি হত্যাকাণ্ড।’

চরম অবহেলা, সম্পত্তির ক্ষতি ও মানসিক আঘাতের অভিযোগ তুলে স্টেইটের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও জানালেন জেরম্যানস্কি।

রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা এবং বীমা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দাবানলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অ্যামেরিকা এ বছর ইতোমধ্যে রেকর্ডসংখ্যক, ১৫টি আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিপর্যয় দেখেছে, যা বছরের প্রথম সাত মাসে কমপক্ষে ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করেছে।