এরদোয়াঁ, নাকি কিলিচদারোলু?

টিবিএন ডেস্ক

মে ২৭ ২০২৩, ২২:৩১

তুর্কিয়ের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়াঁ ও কেমাল কিলিচদারোলু। ছবি: সংগৃহীত

তুর্কিয়ের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়াঁ ও কেমাল কিলিচদারোলু। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

তুর্কিয়ের নতুন প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন তা জানতে অপেক্ষা মাত্র একদিন। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে টানা দুই দশক ক্ষমতায় থাকা রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়াঁই ফের দেশটির শাসন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হবেন কিনা নির্ধারিত হবে রোববারের রান-অফ ভোটে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী প্রার্থী কেমাল কিলিচদারোলুও দিচ্ছেন শক্ত লড়াইয়ের ইঙ্গিত।

প্রথম দফার ভোটে দুজনের কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কারও সামনে প্রেসিডেন্ট পদ উন্মুক্ত হয়নি।

তুর্কিয়ের দক্ষিণ ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ভূমিকম্পে ৫০,০০০-এর বেশি প্রাণহানি এবং ৫.৯ মিলিয়নেরও বেশি বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনার প্রায় চার মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই নির্বাচন।

বিশ্লেষকদের দাবি, দেশটির সাম্প্রতিক গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে এরদোয়াঁ সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম দায়ী।

তুর্কিয়েতে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হয়। প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয় সাবেক পার্লামেন্ট নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটার সমর্থন পেয়েছে এমন দল অথবা মনোনয়ন প্রার্থীদের সমর্থনে কমপক্ষে ১০০ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন তারা। প্রথম রাউন্ডে যে প্রার্থী ৫০ শতাংশ এর বেশি ভোট পান তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে কোনও প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পেলে প্রথম রাউন্ডে সর্বাধিকসংখ্যক ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনটি দ্বিতীয় দফায় (রান-অফ) অনুষ্ঠিত হয়।

সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিলের (ওয়াইএসকে) তথ্য অনুসারে, ১৪ মে প্রথম দফায় ভোটারের উপস্থিতি প্রায় ৯০ শতাংশ ছিল। তবু কোনো একক প্রার্থী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি।

প্রথম দফার নির্বাচনে এরদোয়াঁ পান ৪৯.৫২ শতাংশ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিচদারোলু পেয়েছেন ৪৪.৮৯ শতাংশ ভোট। নির্বাচনের আরেক প্রার্থী সিনান ওগ্যান ৫.২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

রোববারের রান-অফ অনুষ্ঠিত হবে স্থানীয় সময় সকাল ৮টায়, চলবে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। ভোটের ফল প্রকাশিত হবে রাত ৯টার পর।

৬৯ বছর বয়সী এরদোয়াঁ দেশটির ব্যাপক ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক উত্থানের সময় তার শাসন শুরু করেছিলেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি ক্ষমতা সংহত করেছেন। তবে তার অপ্রচলিত রাজস্ব নীতির কারণে তুর্কিয়ের ৮০০ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতি হুমকিতে পড়েছে।

নির্বাচনের প্রথম দফায় ডানপন্থি অ্যানসেস্ট্রাল অ্যালায়েন্স প্রার্থী সিনান ওগান প্রথম রাউন্ডে ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তিনি সোমবার জানান, রান-অফে তিনি এরদোয়াঁকে সমর্থন করছেন এবং তার ভোটারদেরকেও সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শরণার্থী এবং কিছু কুর্দি গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে তাদের প্রতি কঠোর নীতি নিতে উভয় প্রার্থীকে শর্ত দিয়েছেন ওগান।

সিএইচপি-এর প্রতিনিধিত্বকারী ৭৪ বছর বয়সী আইনপ্রণেতা কিলিচদারোলু, রাজনৈতিক সিঁড়ি বেয়ে ২০১০ সালে তার দলের সপ্তম চেয়ারম্যান হন। এর আগে ২০১১ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এরদোয়াঁর কাছে হেরেছিলেন কিলিচদারোলু।

প্রায় ১০০ বছর আগে আধুনিক তুর্কিয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও কঠোর সেক্যুলার মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের গঠন করা পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেন কিলিচদারোলু। তিনি এরদোয়াঁর ইসলামপন্থি দল এবং এর রক্ষণশীল ভিত্তির সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন।

বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ তুর্কিয়ের জনসংখ্যা ৮৫ মিলিয়ন। নেইটোতে দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী দেশটির। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এরদোয়াঁর ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্ব পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অ্যামেরিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২০১৯ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছিল তুরস্ক। এমনকি গত বছর ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সদস্যপদ স্থগিত করে নেইটোর সম্প্রসারণ পরিকল্পনার জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় দেশটি।

সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এরদোয়াঁ জানান, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তুর্কিয়ের ‘বিশেষ’ সম্পর্ক রয়েছে।

এদিকে কিলিচদারোলু বলেন, তিনি পুতিনের সঙ্গে এরদোয়াঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনুসরণ করতে চাইবেন না। বরং মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক পুননির্মাণে কাজ করবেন।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, এ নির্বাচনে এরদোয়াঁ ক্ষমতাচ্যুত হলেও তুর্কিয়ের পররাষ্ট্রনীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না।

নির্বাচনে তুর্কিয়ের ভোটারদের উদ্বেগের মূলে রয়েছে দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি। ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্প বিপর্যয়ের আগেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং মুদ্রা সংকটে ছিল দেশটির জনগণ। গত অক্টোবরে তুর্কিয়ের মুদ্রাস্ফীতি ৮৫ শতাংশে পৌঁছায়।

এ ঘটনা জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছে এবং এ কারণে মূলত এরদোয়াঁর জনপ্রিয়তা কমেছে বলে মনে করেন সাবেক তুর্কিয়ে কূটনীতিক এবং ইস্তাম্বুলভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ইডিএএমের চেয়ারম্যান সিনান উলগেন।

অন্যদিকে সিএনএন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এরদোয়াঁ তার অর্থনৈতিক নীতির সাফাই গেয়েছেন। জনগণের স্বাধীনতার উপর তার হস্তক্ষেপের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

শাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার মাঝেও এরদোয়াঁর ভবিষ্যত খুব একটা অন্ধকার নয় যেমনটা ভোটের আগে ধারণা করা হয়েছিল।

তিনি উল্লেখযোগ্য একটি ধর্মীয় দলের মাধ্যমে সমর্থিত, যারা ক্ষয়প্রাপ্ত অর্থনীতি বা ভূমিকম্পে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সিনিয়র ফেলো সোনার কাগাপ্টে বলেন, এরদোয়াঁর ‘ভালো মুসলিম নন এবং সন্ত্রাসী সমর্থিত’ এই কৌশলটি ডানপন্থি ভোটারদের প্রভাবিত করেছে, যারা কিলিচদারোলুকে নির্বাচিত করতে চেয়েছিলেন।

রোববারের রান-অফ তুর্কিয়েতে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা। নির্বাচনে কী হয় তা দেখার বাকি। তবে এরদোয়াঁ যদি আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তবে তার ‘অপ্রচলিত অর্থনৈতিক নীতি, আইনের শাসনের অভাব এবং সামাজিক স্বায়ত্তশাসন অবসানের জয় হবে’ বলে মনে করেন কাগাপ্টে।


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন