অ্যামাজন জঙ্গলে নিখোঁজের ৪০ দিন পর উদ্ধার চার শিশুর মধ্যে সবচেয়ে বড় সন্তানের বরাতে এ কথা জানিয়েছেন তাদের বাবা ম্যানুয়েল মিলার র্যানোকু।
ওই চার শিশু কলোম্বিয়ার বোগোটার মিলিটারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে তারা।
সাংবাদিকদের র্যানোকু বলেন, “মারা যাওয়ার আগে তাদের মা তাদেরকে বলে, ‘তোমরা এখান থেকে বের হয়ে যাও… নিজেদের বাঁচাও… তোমাদের বাবা আমার মতো করে তোমাদের ভালবেসে আগলে রাখবে’… লেসলি (বড় সন্তান) বলেছে যে তার মা চার দিন বেঁচে ছিল।”
কলম্বিয়ার দুর্গম অ্যামাজন জঙ্গলের অ্যারারাকুয়ারা এলাকা থেকে গত ১ মে স্যান হোসের ডেল গুয়াভিয়ের শহরের উদ্দেশে রওনা দেয় দ্য সেসনা টু-জিরো-সিক্স মডেলের একটি বিমান। দুই পাইলটসহ এতে আরোহী ছিলেন ম্যাগডালেনা মুকুটেয় ও তার চার সন্তান।
কিছুদূর ওড়ার পর রাডার থেকে উধাও হয়ে যায় বিমানটি। সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে দুই সপ্তাহ পর সাউদার্ন ক্যাকুটা প্রভিন্সের জঙ্গলে এর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়। বিমানের ভেতরে পাওয়া যায় দুই পাইলট ও মুকুটেয়ের মরদেহ।
দুর্ঘটনার চার সপ্তাহ অর্থাৎ ৪০ দিন পর চার শিশুকে জীবিত উদ্ধারের কথা জানায় কলম্বিয়ার কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে সবার বড় লেসলি জ্যাকোবোম্বারির বয়স ১৩, তার পরের শিশুটি সোলেনি জ্যাকোবোম্বারি বয়স ৯, তিয়েন র্যানোকুইয়ের বয়স ৪ ও সবার ছোট ক্রিস্টিন র্যানোকুই বয়স মাত্র ১১ মাস।
জঙ্গলেই ক্রিস্টিন এক বছর বয়সে পৌঁছায়, সেই সঙ্গে পাঁচ বছর পূর্ণ হয় তিয়েনের। ছোট তিন ভাইকে ৪০ দিন আগলে রেখেছিল লেসলি।
তাদের উদ্ধারকারী দলের সদস্য নিকোলাস ওরডোনেয উদ্ধারের মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “সবচেয়ে ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে লেসলি দৌঁড়ে আমার কাছে এসে বলে ‘আমি ক্ষুধার্ত’।
“অন্য দুই ভাইয়ের একজনকে আমরা গিয়ে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখি। আমাদের দেখে উঠে বসে সে বলে, ‘আমার মা মরে গেছে’।”
ওরডোনেয জানান, উদ্ধারকারীরা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন। তাদের বলেন যে পরিবারের পক্ষ থেকে উদ্ধারে এসেছেন।
এ কথা শুনে ছোট এক ভাই বলে উঠে, ‘আমি একটু রুটি আর সসেজ খেতে চাই।’
উদ্ধারকারী দলে থাকা আদিবাসী হেনরি গুয়েরেরো বলেন, ‘তারা (শিশুরা) টারপুলিন দিয়ে ছোট্ট একটা তাবু বানিয়েছিল। মাটিতে তোয়ালে পেতে নিয়েছিল। ঘুরে ফিরে তারা নদীর আশপাশেই ছিল। লেসলি সবসময় সঙ্গে সোডার একটা ছোট্ট বোতল রেখেছিল। তাতে পানি ভরে রাখত।’
তিনি বলেন, ‘ওদের মাথায় কেবল একটাই চিন্তা ছিল যে তাদের কিছু না কিছু খেতে হবে। আমাদের দেখে তারা রাইস পুডিং, রুটি- এসব খেতে চেয়েছিল।’
শিশুদের দাদা ফিদেন্সিও ভ্যালেন্সিয়া জানান, বিমান থেকে বের হওয়ার সময় এক ব্যাগ ক্যাসাভা ময়দা নিয়েছিল তারা। সেটি কোনোভাবে খেয়ে এক সপ্তাহ তারা পার করে। এরপর জঙ্গলের বিভিন্ন বীজ ও ফল খেয়ে দিন কাটায়।
এই চার শিশু আদিবাসী হুইটোটো সম্প্রদায়ের সদস্য। জঙ্গলেরই বসতিতে তাদের বেড়ে ওঠা।
তাদের আন্টি ড্যামারেস মুকুটেয় জানান, লেসলি ও সোলেনি জঙ্গলের পরিবেশের সঙ্গে বেশ পরিচিত। প্রায়ই তারা ‘সারভাইভাল গেম’ খেলত।
ড্যামারেস বলেন, ‘লেসলি জানতো কোন ফল বিষাক্ত, আর কোনগুলো খাওয়া যায়। শিশুকে কীভাবে সামলাতে হয় তাও সে জানতো।’
শিশুদের এই বেঁচে যাওয়ার পেছনে অ্যামাজনের প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া রহস্যময় শক্তির অবদান ছিল বলে মনে করেন স্থানীয় আদিবাসী বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স রাফিনো।
তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া তাদের মায়ের আত্মাই শক্তি হয়ে জঙ্গলের প্রকৃতিতে মিশে তাদের রক্ষা করেছে। এখন তিনি বিশ্রাম নেবেন।’