সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের (সিএআর) হয়ে একটি বিদ্রোহী গ্রুপের বিদ্রোহ থামাতে ২০১৮ সালে লড়াই করতে আফ্রিকা আসে ভাগনার গ্রুপ। পরে গোষ্ঠীটি মালি, সুদান এবং লিবিয়াতেও তাদের অভিযান প্রসারিত করেছে। ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ সংঘাত মোকাবিলা করার জন্য আফ্রিকার সরকারগুলোর জন্য লাইফলাইন হয়ে উঠেছে ভাগনার গ্রুপ।
২০১৮ সালে সিএআর এর প্রেসিডেন্ট ফাউস্টিন-আর্চেঞ্জ তোয়াদেরাকে বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করার পর ভাগনার নেতারা রাজধানী বাঙ্গুইতে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। রাশিয়ান ভাষা দেশের স্কুলগুলোতে শেখানো শুরু হয়, সেই সঙ্গে রুশ ভাষা ধীরে ধীরে একটি সরকারি ভাষা হয়ে ওঠে।
মালিতে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আল-কায়েদা এবং আইএসআইএলের (আইএসআইএস) যৌথ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর লড়াই মোকাবিলায় সাবেক ঔপনিবেশিক ফ্রান্সের সঙ্গে কাজ করে মালি সরকার। এক দশকব্যাপী যৌথ চেষ্টায় কাজ না হওয়ায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলে মালি এবং তারা ভাগনারের সঙ্গে যুক্ত হয়।
রাশিয়ায় গত সপ্তাহের ভাগনার বিদ্রোহের পরে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ সশস্ত্র ভাগনার গ্রুপের বিদেশি কার্যকলাপের ওপর পড়েছে। একইসঙ্গে রাশিয়া এবং আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরও প্রভাব পড়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গত সপ্তাহে বলেছেন, সিএআর এর ‘কয়েক শতাধিক সার্ভিসম্যান’ যারা সরকারের নির্দেশে ‘প্রশিক্ষক’ হিসাবে কাজ করছেন তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।
ওয়েস্ট আফ্রিকা থিঙ্ক ট্যাঙ্কের (ডব্লিউএটিএইচআই) প্রতিষ্ঠাতা ইয়াবি গিলস বলেছেন, এই মন্তব্যমোটেই অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়।
গিলস বলেন, ‘লাভরভের ঘোষণাটি ছিল সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। ভাগনার শুধু একটি ভাড়াটে কোম্পানি নয়। ভাগনার এমন একটি কোম্পানি যাকে রাশিয়ান সরকার সহ্য করেছে এবং রাশিয়ার স্বার্থেও কাজ করছে। বিশেষ করে দেশের বাইরে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। মালি এবং সিএআর-এর জন্য, রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে এমন নিশ্চয়তা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্য বেসরকারি সামরিক গ্রুপগুলো আফ্রিকায় কাজ শুরু করেছে। ভাগনার এখন মহাদেশ থেকে সৈন্য সরিয়ে নিলেও অন্যান্য সামরিক গ্রুপগুলোকে বিকল্প হিসেবে পাওয়া যাবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সিএআর এর সিনিয়র বিশ্লেষক চার্লস বোয়েসেল বলেন, ‘নতুন কোম্পানিগুলোর ম্যানেজারদের আফ্রিকায় ভাগনারের কার্যকলাপ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রয়েছে। ভাগনারের সাবেক কর্মচারী এবং রাশিয়া সহজেই এসব লোকদের ব্যবহার করে ভাগনারের সমস্ত কার্যক্রম, বিশেষ করে সেন্ট্রাল আফ্রিকায় ভাগনারের প্রভাব পুনরুদ্ধার করতে পারে।’
টিমবুকটু ইনস্টিটিউট আফ্রিকা সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের আঞ্চলিক পরিচালক বাকারি সেম্বে মনে করেন, নিরাপত্তা ইস্যুতে বাইরের লোকবল ব্যবহারে আরও সতর্ক হওয়া জরুরি। আফ্রিকার দেশগুলোকে ভাগনার নিয়ে এখনই ভাবা উচিত।
মস্কোর আশ্বাসের পরেও মালি এবং সিএআর একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রয়েছে।
সেম্বে বলেন, ‘মালি এবং অন্যান্য দেশ যারা এই ভাড়াটে গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা এখন ভাগনারের অস্ত্র এবং মস্কোর ক্রোধের মধ্যে আটকা পড়েছে।’
মালিতে সংঘাত শুরু হওয়ার পর ২০১৩ সালে ফ্রান্সের সৈন্যরা মালির হয়ে লড়াই শুরু করে। বামাকোর অনুরোধে ফ্রান্স পরে সৈন্য প্রত্যাহার করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দেয়ার পর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীও বেরিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলেছেন, এটি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখানো পদক্ষেপ ছিল। আগে এই অঞ্চলে একমাত্র বাহ্যিক প্রভাব ছিল ফ্রান্সের। সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিস্তার রোধ করতে ব্যর্থ হওয়া এবং স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করে ফ্রান্স ভাগনারের জন্য আফ্রিকার দরজা খুলে দিয়েছিল। যে গ্রুপটির নেতৃত্বে আছেন নির্বাসিত ইয়েভজেনি প্রিগোজিন।
সেম্বে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘ফ্রাঙ্কোফোন দেশগুলোতে রাশিয়ার উপস্থিতি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। এটি বিদ্রোহের একটি চিহ্ন। এটি তাদের পশ্চিমের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করেছে।’
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ফ্রান্স যখন মালিতে শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ তখনই ভাগনার গ্রুপ এসে মালির পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
জাতিসংঘের বাহিনী চলে যাওয়া এবং ভাগনার গ্রুপ অস্থিতিশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মালির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পরার উপক্রম হয়েছে। ইতিমধ্যে সাহেল অঞ্চলে ভাগনার বিদ্রোহের প্রভাবে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে ।
বোয়েসেল বলেছেন, ‘নেতৃত্বে পরিবর্তন সম্ভবত অবস্থাকে খারাপ করবে না। ভাগনারের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হবে না। কার্যক্রমগুলো আফ্রিকায় কাছাকাছি অবস্থাতেই থাকবে। প্রিগোজিন হোক বা যুদ্ধের নতুন নেতৃত্ব হোক, এটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ নয়; কোম্পানিকে কে নিয়ন্ত্রণ করবেন সেটাই এখন আসল প্রশ্ন।’