সিডনির সেমিনারে তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান

টিবিএন ডেস্ক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮ ২০২৫, ০:৫২

সিডনিতে  ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি সামিট ২০২৫: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার ডাক’  শীর্ষক এক সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বক্তারা। ছবি: টিবিএন

সিডনিতে ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি সামিট ২০২৫: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার ডাক’ শীর্ষক এক সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বক্তারা। ছবি: টিবিএন

  • 0

গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মুবাশ্বার হাসান বলেন, ‘আমি দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলে শেষ করতে চাই। প্রথমত, আমাদের গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে যে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের সাথে আমার আচরণ কী হবে, আমরা হয়তো সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারি, কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কী? আমরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর কোনো সহিংসতার চক্র দেখতে চাই না।’

বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন তফসিল ঘোষণা এবং একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি বলে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা।

দেশটির সিডনিতে ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি সামিট ২০২৫: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার ডাক’ শীর্ষক এক সেমিনারে একাধিক বক্তা এমন দাবি করেন।

বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক এবং বাংলাদেশ কমিউনিটি কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ রাশেদুল হকের সর্বিক তত্ত্বাবধানে শনিবার সন্ধ্যায় সিডনির ল্যাকাম্বা লাইব্রেরি মিলনায়তনে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।

এতে বক্তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশে ফিরে আসার সুযোগ তৈরি করতে হবে, যাতে তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বে অংশ নিতে পারেন।

সেমিনারে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

এতে উপস্থিত অতিথিরা জোর দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মনিটরিং, মানবাধিকার সুরক্ষা ও রাজনৈতিক দলের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অনুষ্ঠানে সাবেক সিনেটর লি রিহানানকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে বিশেষ অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়।

অভ্যর্থনা পেয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে লি রিহানান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রাম অত্যন্ত জরুরি এবং আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক দিন পরই জাতিসংঘের মানবাধিকার দিবস, যা গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং তার প্রচার ও কার্যকর নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘গত ১৪-১৬ মাস বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে যে উত্তেজনা ও পরিবর্তন এসেছিল, যখন দীর্ঘদিনের এক স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে, কিন্তু এর জন্য অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে—প্রায় ১৪০০ মানুষ, যাদের অধিকাংশই তরুণ, নির্মমভাবে নিহত হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে।

‘এটি এখন ইতিহাসের অংশ, কিন্তু এই আত্মত্যাগ আমাদের মনে রাখতে হবে। এখন গণতন্ত্র পুনর্গঠনের জন্য কাজ করতে হবে।’

অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনস দলের সিনেটর ডেভিড শোবারিজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যে, এখন থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে (নির্বাচনের সময়) কী ঘটছে। তারা অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের কাছে সর্বোচ্চ মানদণ্ড দাবি করছে।

‘এমন একটি সময়ে, যখন সংবিধান পরিবর্তনের কথার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং মৌলিক অধিকার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তখন পরিবর্তন আনতে জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে কখনোই অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। কারণ এখনকার একটি ছোট পদক্ষেপ আগামী দশকগুলোর জন্য উল্লেখযোগ্য এবং বড় সংস্কার ও সুবিধা বয়ে আনতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি আমার পক্ষ থেকে যা করা সম্ভব করব, যাতে অস্ট্রেলিয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ওপর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাগিদ দেয়।

‘আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, ফেডারেল পার্লামেন্ট সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশনবিষয়ক আইন পরিবর্তন করেছে। এর ফলে অস্ট্রেলিয়া এখন শুধু অপরাধ করা ব্যক্তি বা বেসরকারি সংস্থাকেই নয়, বরং সরকারের কোনো সংস্থাকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে পারবে। এটি অত্যন্ত চমৎকার একটি পদক্ষেপ।’

প্রভাবশালী এ সিনেটরের মতে, এ পরিবর্তনের ফলে অস্ট্রেলিয়ার সরকার ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখানকার ইরানি প্রবাসীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তা কার্যকর করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সোচ্চার ডেভিড শোবারিজ বলেন, ‘‘আরেকটি সরকারি সংস্থা আছে, যার রাজনৈতিক গুম, সহিংসতা এবং ভীতি প্রদর্শনের দীর্ঘ ও জঘন্য ইতিহাস রয়েছে। আর সেটি হলো র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গত তিন বছর ধরে আমি অস্ট্রেলিয়ান সরকারের কাছে র‌্যাব এবং এর নেতৃত্বের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়ে আসছি।’

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস পার্লামেন্টের সদস্য এবিগেইল বয়েড অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে না পারলেও এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমি আপনাদের সাথে সংহতি জানাতে পেরে গর্বিত। বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আর মাত্র দুই মাস বাকি। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনর্গঠনের পথে এখনও ব্যাপক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।’

তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশটি এখনও অস্থিরতা, সহিংসতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের প্রভাবমুক্ত না হলে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।

‘যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী, তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত একটি ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক পরিবর্তন হতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি আমি নিউ সাউথ ওয়েলস পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাস করেছি, যেখানে অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চিঠি লেখার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করে এবং নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের নিরাপত্তা ও চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।’

নিউ সাউথ ওয়েলস পার্লামেন্টের সদস্য অ্যান্থনি ডি'অ্যাডাম বলেন, ‘আমি হয়তো কিছুটা ভিন্ন বা বিতর্কিত একটি অবস্থান থেকে কথা বলতে চাই। গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে আমার আগ্রহ রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া হোক বা বিশ্বের অন্য কোনো দেশ—গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জ।’

তিনি বলেন, “আমাদের সমস্যাটি একটি নীতিগত জায়গা থেকে দেখা প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ সংঘাত শেষে বিশ্বনেতারা একটি নতুন আন্তর্জাতিক কাঠামো তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেটি ছিল ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা’ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির ওপর ভিত্তি করে তারা কার্যকরভাবে মানবাধিকারকে ঘিরে একটি আদর্শ বা ‘নর্ম’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন—এই বিশ্বাসে যে, মানবাধিকার একটি মৌলিক অধিকার যা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের ভোগ করা উচিত।”

গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মুবাশ্বার হাসান বলেন, ‘আমি দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলে শেষ করতে চাই। প্রথমত, আমাদের গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে যে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের সাথে আমার আচরণ কী হবে, আমরা হয়তো সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারি, কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কী? আমরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর কোনো সহিংসতার চক্র দেখতে চাই না।

‘দ্বিতীয়ত, অস্ট্রেলিয়ান সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে কাজ করে, তখন তাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের করের টাকা যেন এমন কোনো ব্যক্তিকে অর্থায়ন না করে, যারা গুম বা গোপন কারাগার (আয়নাঘর) পরিচালনার সাথে জড়িত ছিল। আমাদের লক্ষ্য হলো একটি গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী সমাজ গঠন করা। বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যা আইনের শাসন এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লিমা আক্তার বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দুটি দিক নিয়ে কথা বলব। ১. শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা এবং ২. প্রতিরোধমূলক নিষেধাজ্ঞা । যদি কোনো রাজনৈতিক দল গণহত্যা বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে তাদের নিষিদ্ধ করা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আইনের শাসনের বাস্তবায়ন।’
নুরেমবার্গ ট্রায়াল এবং জার্মান আইনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য—যারা গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করতে চায় (যেমন হিটলারের নাৎসি পার্টি)—তাদের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়।’

অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটির সিনিয়র সহসভাপতি এএফএম তাওহীদুল ইসলাম আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অস্ট্রেলিয়ার একটি বড় পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর কথা বলেন।
তিনি র‌্যাবকে বিলুপ্ত করার আহ্বান এবং অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের মধ্য বাণিজ্য আরও বেশি সম্প্রসারণের আহ্বান জানান।

তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার উঁচু সারির বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি কলেজগুলোকে বাংলাদেশে তাদের ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের আহ্ববান জানান। একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদ সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি যেন অস্ট্রেলিয়াকে নিরাপদ আবাসস্থল বানাতে না পারেন, তার জন্য দেশটির সরকারকে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্ববান জানান।

অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী সিনেটর ডেভিড শোবারিজের সঞ্চালনায় পুরো অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

সিডনিতে বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার এ রাজনীতিবিদদের বাংলাদেশের প্রতি তাদেরে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার জন্য উৎসাহ দেন।