এমনই এক ‘হাশ মানি’ স্ক্যান্ডাল শেষ পর্যন্ত সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে ফৌজদারি আসামির কাঠগড়ায় নিয়ে গেছে। আদালতে মঙ্গলবার হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করছেন তিনি।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাশ মানি নিউ ইয়র্কে অবৈধ নয়। তবে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে হাশ মানির সঙ্গে ব্যবসায়িক জালিয়াতি জড়িয়ে যাওয়া ঘটনাটি এতদূর গড়িয়েছে।
যেভাবে হাশ মানি স্ক্যান্ডালে জড়ালেন ট্রাম্প
পর্নস্টার স্টর্মি ড্যানিয়েল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই হাশ মানির অভিযোগ তুলেছেন। তিনি জানান, ঘটনার শুরু ২০০৬ সালে। সে সময় ট্রাম্প তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে ঘর করছেন। একটি জনপ্রিয় রিয়ালিটি শো-এর সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। রাজনীতিতে তখনও তার বিচরণ শুরু হয়নি।
স্টর্মি জানান, একটি গলফ টুর্নামেন্টে ট্রাম্পের সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর তাদের শারীরিক সম্পর্ক হয়। ট্রাম্প তাকে রিয়েলিটি শোতে নেয়ার কথা দিয়েছিলেন, যা পরে রাখেননি।
এর ১০ বছর পর ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান ট্রাম্প। ড্যানিয়েলের অভিযোগ, সে সময় ইমেজ ক্লিন রাখতে ট্রাম্প তাকে একটি অপ্রকাশযোগ্য চুক্তিনামায় সই করতে বলেন।
ওই চুক্তিতে বলা ছিল, ট্রাম্প ও তার মধ্যেকার শারীরিক সম্পর্কের ঘটনা কাউকে বলা যাবে না। চুক্তিতে সই করা বাবদ ট্রাম্প তাকে ১৩০ হাজার ডলার দেন। স্টর্মির পক্ষ থেকে আইনজীবী কেইথ ড্যাভিডসন এবং ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আইনজীবী মিশেল কোহেন চুক্তিনামা ও আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি দেখভাল করেন।
সে বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এই রিপাবলিকান নেতা।
এর আগে ড্যানিয়েল ২০১১ সালে দ্য টাচ নামের একটি ম্যাগাজিনে ঘটনাটি প্রকাশ করে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তবে সাক্ষাৎকারটি সে সময় প্রচার হয়নি।
২০১৮ সালে সিএসবি নিউজে আরেকটি সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সেখানে অভিযোগটি নিয়ে ফের কথা বলেন। সেটি প্রচার হওয়ায় সামনে আসে ‘হাশ মানি স্ক্যান্ডাল’।
এরপর ট্রাম্পের আইনজীবী কোহেন প্রকাশ্যে ড্যানিয়েলকে হাশ মানি দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে নিজের ওপর দায় নিয়ে তিনি বলেন, নিজ পকেট থেকেই ওই ডলার দিয়েছিলেন, ট্রাম্প তাকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশ দেননি। আর ওই অর্থ নির্বাচনি প্রচারের কোনো খাত থেকেও যায়নি। অর্থাৎ এই আর্থিক লেনদেন অবৈধ ছিল না।
তবে ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট থেকে কোহনকে দেয়া অর্থের লেনদেনের রেকর্ড সে সময় ফাঁস হয়ে যায়। অভিযোগ ওঠে, ড্যানিয়েলকে চুপ করানোর বিনিময়ে ট্রাম্প কোহেনকে ৪২০ হাজার ডলার দেন। এই অর্থ ট্রাম্প অরগানাইজেশন থেকে পরিশোধ করা হয়।
ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেন, এটা কোহেনের লিগ্যাল ফি ছিল। ট্যাক্সের কাজের বিনিময়ে তিনি এই অর্থ দিয়েছিলেন। আর ড্যানিয়েলকে কোহেনের হাশ মানি দেয়ার ঘটনা তিনি জানতেন না।
ঘটনা পরে গড়িয়েছে মামলা পর্যন্ত, আসামি হন কোহেন। ট্যাক্স ফাঁকি, জালিয়াতি ও প্রচারকাজের খাতের নিয়ম লঙ্ঘনসহ আটটি অপরাধে দোষি সাব্যস্ত করা হয় কোহেনকে। দেয়া হয় তিন বছরের কারাদণ্ড।
আদালতে কোহেন এসব কিছুর জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেন। তিনি এবার স্বীকার করেন, স্টর্মি ড্যানিয়েলের মুখ বন্ধ করতে ট্রাম্পই তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই হাশ মানিও ট্রাম্পের কথায় দেয়া হয়েছে। কাজটি করার জন্যই ট্রাম্প তাকে ৪২০ হাজার ডলার দেন।
কোহেনের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ম্যানহাটন ডিস্টিক্ট অ্যাটর্নির কার্যালয় থেকে তদন্ত শুরু হয়। তদন্তের উদ্দেশ্য, ট্রাম্প অরগানাইজেশন থেকে ওই আর্থিক লেনদেন নিউ ইয়র্কের আইনে অবৈধ কি না- তা খতিয়ে দেখা। তবে ফেডারেল প্রসিকিউটরদের অনুরোধে সেই তদন্ত বন্ধ করা হয়।
এর প্রায় এক বছর পর ২০১৯ সালের আগস্টে তখনকার ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি সাইরাস আর. ভ্যান্স নিজ থেকে বিষয়টি তদন্ত করতে উদ্যোগী হন। তার অফিস থেকে ট্রাম্পের আট বছরের ট্যাক্স রিটার্নের রেকর্ড চাওয়া হয়।
সে বছর সেপ্টেম্বরে ট্রাম্পের আইনজীবীরা তার ট্যাক্স রিটার্ন রেকর্ড প্রকাশ না করতে মামলা করেন। তারা বলেন, একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে ফৌজদারি অভিযোগে তদন্তের মুখোমুখি করা যাবে না। এ মামলার কারণে অ্যাটর্নি ভ্যান্সের তদন্ত আটকে যায়।
এরপর ২০২০ সালের জুলাইয়ে ট্রাম্পের আইনজীবীদের মামলা সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দেয়। চিফ জাস্টিস জন রবার্টস জানান, অন্য নাগরিকের মতো প্রেসিডেন্টকেও অপরাধ তদন্তের সমস্ত প্রক্রিয়ায় সাড়া দিতে হবে। এর পর অ্যাটর্নি ভ্যান্সের তদন্ত ফের গতি পায়।
তবে ২০২১ সালের শেষদিকে ভ্যান্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হয়ে আসেন অ্যালভিন ব্র্যাগ। ট্রাম্পের অবৈধ আর্থিক লেনদেনের তদন্ত তিনি চালিয়ে নেন। পরের বছর এপ্রিলে ব্র্যাগ জানান, তদন্তে এমন কিছু প্রমাণ পেয়েছেন যা আগে বের হয়নি।
ড্যানিয়েলের ‘হাশ মানি’ অভিযোগও ফের প্রাণ পায়।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিসের তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোহেন দেখা করেন। এরপরই গুঞ্জন ওঠে, হাশ মানির তদন্ত বুঝি আবার শুরু হলো।
ট্রাম্পকে হাশ মানি ও ব্যবসায়িক জালিয়াতির অভিযোগে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করা যাবে কি না- তা যাচাইয়ে গ্র্যান্ড জুরি গঠন করেন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ব্র্যাগ।
মার্চ পর্যন্ত চলে তদন্ত। এতে ডাকা হয় ট্রাম্প, ড্যানিয়েল ও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। অবশেষে গত ৩০ মার্চ ট্রাম্পকে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করে গ্র্যান্ড জুরি।