নেতানিয়াহুকে প্রথমবার অ্যামেরিকায় আমন্ত্রণ জানালেন বাইডেন

টিবিএন ডেস্ক

জুলাই ১৮ ২০২৩, ৩:১৭

২০১০ সালে জেরুযালেমে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও জো বাইডেন। ছবি: সংগৃহীত

২০১০ সালে জেরুযালেমে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও জো বাইডেন। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

প্রেসিডেন্ট বাইডেন সোমবার ইযরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে অ্যামেরিকায় একটি বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। গত ডিসেম্বরে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম নিমন্ত্রণ পেলেন নেতানিয়াহু। এতে করে দুই নেতার মধ্যে কয়েক মাসের চলমান উত্তেজনা হ্রাস পেল।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, ইযরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের অ্যামেরিকা সফরের আগেরদিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন। সোমবার নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন সন্ধ্যায় একটি ফোন কলে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নেতানিয়াহুর কার্যালয় দুই নেতার ফোন কলটিকে ‘উষ্ণ ও দীর্ঘ’ হিসেবে বর্ণনা করে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্প্রতি নেতানিয়াহুর জোটকে ১৯৭০ দশকের পর থেকে ‘সবচেয়ে চরমপন্থী’ হিসাবে বর্ণনা করেন ও ইযরায়েলের সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করার, অধিকৃত পশ্চিম তীরে আরও ইযরায়েলি বাড়ি নির্মাণ ও সরকারি অনুমোদন ছাড়া ইযরায়েলি বসতি স্থাপনের মেনে নেয়ার বিষয়ে বিশেষভাবে বিরোধিতা করেন।

ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কারবি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইযরায়েলে বিচার বিভাগীয় সংস্কার নিয়ে বর্তমান বিতর্কের প্রেক্ষাপটে পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, সর্বোত্তম ঐক্যমতের প্রয়োজন ও যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি সবসময় অ্যামেরিকা-ইযরায়েল সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য ছিল সেগুলো বজায় থাকবে।’

নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ জানানোর ঘোষণাটি ইযরায়েলের বিরোধী দলের জন্য হতাশাজনক। তারা বাইডেন প্রশাসনকে নেতানিয়াহুর বিচারিক সংশোধনের বিপক্ষে আরও শক্তিশালী অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার দেশে বিচার বিভাগের প্রভাব সীমিত করার জন্য একটি বিতর্কিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। এই পরিকল্পনাটি ইযরায়েলে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এর বিশেষ সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে অ্যামেরিকা-ইযরায়েল অংশীদারত্বের ভিত্তি হওয়া উচিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।

নেতানিয়াহু কবে সফর করছেন সেটা নির্ধারিত হয় নি। হোয়াইট হাউয না অন্য কোথাও হবে তার সফর সেটাও চূড়ান্ত নয়। তবে মঙ্গলবার দুই দেশের শীর্ষ নেতার বৈঠককে ঘিরে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা প্রশমিত করল এই আমন্ত্রণ। ইযরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। পরদিন দুই নেতা কংগ্রেসের সামনে বক্তব্য রাখবেন।

প্রেসিডেন্ট হারজগকে আনুষ্ঠানিক স্বাগতম জানানোর মাধ্যমে অ্যামেরিকা সরকার যে ইযরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রধান কৌশলগত ও সামরিক মিত্র হিসাবে দেখে তা আবারও প্রমাণিত হলো। অ্যামেরিকা ইযরায়েলকে বার্ষিক প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপক কূটনৈতিক সাহায্য ও আরব দেশগুলির সঙ্গে নতুন জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করে।

নেতানিয়াহুর সঙ্গে সংঘাতের পরও বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া বন্ধ করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর শীর্ষ পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্যগুলির মধ্যে একটি, ইযরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক, সে জন্যও জোর চেষ্টা চালাচ্ছে হোয়াইট হাউয ।

বাইডেন প্রশাসন এরপরও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি বৃদ্ধির বিষয়ে ক্রমবর্ধমান হতাশা প্রকাশ করে আসছে। অ্যামেরিকান কর্মকর্তারা পশ্চিম তীরে ইযরায়েলের বসতি স্থাপনকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনে একটি প্রধান বাধা হিসাবে দেখেন। এটি ইযরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের পছন্দের সমাধান। যদিও অনেক বিশ্লেষক এই সিদ্ধান্তে আসছেন যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আর সম্ভব নয়।

ওয়াশিংটন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার চরমপন্থী সদস্যের মন্তব্যেরও তিরস্কার করেছে। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচের বক্তব্য যেখানে তিনি বলেছিলেন, যে ইসরায়েলি রাষ্ট্রকে একটি ফিলিস্তিনি শহরকে ‘নিশ্চিহ্ন করে ফেলা’ উচিত। স্টেইট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইস এই মন্তব্যকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন, ঘৃণ্য এবং প্রতিকূল’ বলে অভিহিত করেছেন।

নেতানিয়াহুর কয়েকজন ইযরায়েলি সমালোচকের কাছে, বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীরা সাম্প্রতিক দিনগুলিতে অন্তত দুইবার তেল আভিভে অ্যামেরিকান দূতাবাসের বাইরে জড়ো হয়েছে। তাদের মধ্যে কারও কারও হাতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রতি ‘আমাদের বাঁচান!’ লেখা ব্যানারও দেখা গেছে।

নেতানিয়াহুর সমর্থকদের কাছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি খুব বেশি জোরপূর্বক মনে হয়েছে। নেতানিয়াহুর প্রবাস বিষয়ক মন্ত্রী আমিচাই চিকলি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন যা নিয়ে আপত্তি করেছেন সেগুলো ইযরায়েলি বিরোধীদের শক্তিদের দ্বারা ‘প্রাথমিকভাবে সাজানো ও আয়োজিত’ ছিল। বাইডেনের রাষ্ট্রদূত টমাস আর নিডস নেতানিয়াহুকে তার বিচার বিভাগীয় সংশোধনকে ধীর করার পরামর্শ দেওয়ার পরে, চিকলি তাকে ‘নিজ চরকায় তেল’ দেয়ার কথা বলেছিলেন।

সোমবার, ইযরায়েলের শিক্ষামন্ত্রী, ইয়োভ কিশ, এক রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেন: ‘আমি স্পষ্টভাবে বলছি; অবশ্যই প্রেসিডেন্ট হারজগের বদলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সফর করা উপযুক্ত হত’। আমি খুশি যে রাষ্ট্রপতি ভ্রমণ করছেন এবং আমি মনে করি এটি গুরুত্বপূর্ণ। আসল বিষয় হল যে, বাইডেনের সঙ্গে এই পুরো ঘটনাটি ইযরায়েল রাষ্ট্রের ভেতরের উপাদানগুলো থেকে ইন্ধন পাচ্ছে ও বড় হচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইযরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক বেশ কয়েকবার আশঙ্কাপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৫০-এর দশকে, আইজেনহাওয়ার প্রশাসন মিশর আক্রমণের জন্য ইযরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়নের সঙ্গে বিরোধে জড়ায়।

১৯৬৭ সালে মিশরে দখল করা অঞ্চল থেকে ইযরায়েলের সরে আসার অনিচ্ছার কারণে সম্পর্ক শীতল করে ফোর্ড প্রশাসন। ১৯৯০ এর দশকে, প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ.ডব্লিউ. বুশ ও বিল ক্লিনটন বসতি নির্মাণ নিয়ে নেতানিয়াহুসহ টানা কয়েকজন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন।

দুই দশক পরে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট ওবামার পরামর্শ ছাড়াই কংগ্রেসে নিজের যৌথ ভাষণ দেওয়ার পর দুই নেতার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

এ মতবিভেদের বেশিরভাগই নির্দিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু যেমন, মিশর, ইরান বা ফিলিস্তিনকে নিয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। ওয়াশিংটনে সাবেক ইযরায়েলি রাষ্ট্রদূত ইতামার রাবিনোভিচের মতে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মধ্যে বিবাদটি ভিন্ন। এটি আংশিকভাবে মূল্যবোধের বিরোধ সংক্রান্ত।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন পরামর্শ দিয়েছেন যে নেতানিয়াহুর বিচার বিভাগকে সীমিত করার পরিকল্পনা ইযরায়েলের গণতন্ত্রের চরিত্রকে পরিবর্তন করবে ও অ্যামেরিকা-ইযরায়েল জোটের মূলে রয়েছে সরকার পরিচালনার ওপর একটি অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, এমন ধারণাকে দুর্বল করবে।

রাবিনোভিচ বলেন, ‘আগের মতপার্থক্য ছিল নীতির উপর। এবারের বিরোধ ইসরায়েলের সত্তা নিয়ে।’

নেতানিয়াহুর সমালোচকদের বেশিরভাগের পূর্বাভাস ছিল যে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে হারজগের সাক্ষাৎ নেতানিয়াহুর প্রতি বাইডেনের পদক্ষেপকে আরও কম কঠোর করে তুলবে।

হারজগ নেতানিয়াহুর একজন সাবেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। হারজগ একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও পরিচিত, যিনি এই বছর সরকার ও এর বিরোধীদের মধ্যে সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা করেছিলেন যে হারজগ, উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য, নেতানিয়াহুকে বছরের শেষের দিকে হোয়াইট হাউযে আমন্ত্রণ জানাতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে রাজি করিয়ে ফেলবেন।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য, কয়েকজন বিক্ষোভকারী নেতানিয়াহুর ছবির ওপর মুখোশ হিসেবে হারজোগের মুখ ব্যবহার করেছেন।

নেতানিয়াহুর জীবনীকার ও সমালোচক বেন ক্যাসপিট, সোমবার এক সংবাদপত্রের কলামে প্রেসিডেন্ট হারজগের প্রতি সরাসরি সতর্কবার্তা দিয়েছেন।

ক্যাসপিট লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট হারজোগ, আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আপনি যখন হোয়াইট হাউসে থাকবেন, সেখানে যেন আপনি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আইনজীবী হিসেবে না থাকেন। আপনি সেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের আইনজীবী হিসেবে থাকবেন। আপনার কাজ বাইডেনের কাছে নেতানিয়াহুকে ‘বিক্রি’ করা নয়।”

হারজগ তার সফরকে অরাজনৈতিক করার চেষ্টা করেছেন। সপ্তাহান্তে, তার অফিস একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে যে তিনি ইরানের হুমকি তুলে ধরতে এই সফরটি ব্যবহার করবেন এবং ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের সময় নিহত এক সৈনিকের মা লেয়া গোল্ডিন তার সঙ্গে থাকবেন। গোল্ডিনের নিহত ছেলের দেহাবশেষ জঙ্গিরা ফিলিস্তিনি ছিটমহলে রেখে দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট হারজগ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমি ইযরায়েল রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে সমগ্র ইযরায়েল জাতির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অত্যন্ত উন্মুখ হয়ে আছি।’


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন