রুডি ফারিয়াসের রহস্যে ঘেরা ‘ফিরে আসা’

নাঈমা সুলতানা, টিবিএন ডেস্ক

জুলাই ৮ ২০২৩, ২২:৩৮

টেক্সাসের তরুণ রুডি ফারিয়াসের সন্ধান চাওয়া পোস্ট (বাঁয়ে) ও  তার মা জেইনি স্যান্টানা। ছবি কোলাজ: টিবিএন

টেক্সাসের তরুণ রুডি ফারিয়াসের সন্ধান চাওয়া পোস্ট (বাঁয়ে) ও তার মা জেইনি স্যান্টানা। ছবি কোলাজ: টিবিএন

  • 0

টেক্সাসে ১৭ বছর বয়সে ‘হারিয়ে যাওয়া’ তরুণের আট বছর পর ফিরে আসার ঘটনা এ মাসের শুরু দিকে অ্যামেরিকায় বেশ আলোচিত হয়। মায়ের বুকে সন্তানের ফিরে আসার খবরে আবেগাপ্লুত হন অনেকে। দুই দিন পর ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। মুহূর্তেই সেই মা পরিণত হন ভিলেনে। ছেলেটির ‘ফিরে আসা’ নিয়ে দানা বাঁধে রহস্য।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এক স্যোশাল অ্যাক্টিভিস্টের বরাতে জানায়, রুডি ফারিয়াস নামের ওই তরুণ কখনই নিখোঁজ ছিলেন না। মা জেইনি স্যান্টানার সঙ্গে এত বছর হিউস্টনে নিজ বাড়িতেই ছিলেন। ছেলেকে ‘যৌন দাস’ হিসেবে ব্যবহার করতেন স্যান্টানা।

রুডির নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি বানোয়াট ছিল বলে জানায় হিউস্টন পুলিশ। তবে তাকে ‘যৌন দাস’ হিসেবে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল কিনা- তা অফিসাররা নিশ্চিত করেননি। কেন এত বছর স্যান্টানা ছেলেকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন- সে প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর তারা পাননি।

এদিকে রুডি ও তার মা স্যান্টানার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।


যেভাবে ‘নিখোঁজ’ রুডি ফারিয়াস

হিউস্টনের জেইনি স্যান্টানা ২০১৫ সালের মার্চে পুলিশের কাছে ছেলে রুডি ফারিয়াসের মিসিং রিপোর্ট করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই মার্চের ৫ তারিখ বাড়ি থেকে দুই কুকুরকে হাঁটানোর কথা বলে বের হন রুডি। কুকুর দুটি বাড়ি ফিরলেও রুডি সেদিন থেকে নিখোঁজ।

রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় রুডির বয়স ছিল ১৭ বছর।

ছেলের খোঁজ পেতে অনলাইন তহবিল সংগ্রাহক প্রতিষ্ঠান গো ফান্ড মি- এর ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খোলেন। অ্যাকাউন্ট থেকে ২২ মার্চ ছেলের খোঁজে আর্থিক সহায়তা চেয়ে পোস্ট করেন। তাতে বলা হয়, রুডি শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী।

গো ফান্ড মি প্রতিষ্ঠানটি পরে জানায়, তাদের মাধ্যমে দুই হাজার ডলার তহবিল সংগ্রহ করেন স্যান্টানা।

পুলিশ রিপোর্টেও ছেলের মানসিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেন তিনি। রিপোর্ট অনুযায়ী, রুডি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজওর্ডার- পিটিএসডি, বিষণ্নতা ও উদ্বেগ্নে আক্রান্ত।

হিউস্টনের এই বাড়িতে আট বছর আত্মগোপনে ছিলেন রুডি


স্থানীয় টেলিভিশনে ২০১৭ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্যান্টানা বলেন, ছেলে অপহরণ ও মানব চোরাচালানের শিকার হয়ে থাকতে পারেন বলে গোয়েন্দারা তাকে জানিয়েছেন।


রুডির ‘নিখোঁজ’ নিয়ে প্রথম সন্দেহ

রুডির নিখোঁজ হওয়া নিয়ে সন্দেহ শুরু হয় ২০১৮ সালে।

রুডির কাজিন ক্যাসান্দ্রা লোপেজ সে বছর হিউস্টন পুলিশকে ফোন করে জানান, রুডিকে নিজ বাড়িতেই দেখা গেছে। তবে অফিসাররা ওই বাড়িতে গিয়ে তাকে খুঁজে পাননি।

লোপেজ পরে জানান, কথিত নিখোঁজকালে তার গ্র্যান্ডমাদারের সঙ্গে রুডির প্রায়ই ফোনে কথা হতো।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে প্রতিবেশীরাও এরপর দাবি করেন, ২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময় রুডিকে বাড়ির আশপাশে দেখা গেছে। তবে তাকে নিজের ভাগনে ‘ডলফ’ বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন স্যান্টানা।

কথিত নিখোঁজের তিন বছরে চেহারা ও শারীরিক কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে প্রতিবেশীরা স্যান্টানার কথা বিশ্বাস করে নেন।

ওদিকে রুডির সন্ধানে তখনও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল এইচপিডির মিসিং পারসন ইউনিট, তবে কোনো কূল-কিনারা মিলছিল না।


রুডি ফারিয়াসের ‘ফিরে আসা’

আট বছর পর ছেলেকে খুঁজে পেয়েছেন বলে গত ৩ জুলাই স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দেন জেইনি স্যান্টানা।

তাতে বলেন, ‘আট বছর পর গত ২৯ জুন বৃহস্পতিবার আমার ছেলে রুডি ফারিয়াসকে ফিরে পেয়েছি… এ বিষয়ে এখনই বিস্তারিত কিছু জানাতে পারছি না… এক সহৃদয়বান ব্যক্তি আমার ছেলেকে খুঁজে পেয়ে পুলিশকে কল করেন। তাকে এখন চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। সে কোনো কথা বলছে না…।’

পোস্টের সঙ্গে হাসপাতালের বেডে শোয়া রুডির ছবিও দেন তিনি। তবে তাতে রুডির চেহারা বোঝা যাচ্ছিল না।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রুডির এই ছবি পোস্ট করেন তার মা

আরেকটি পোস্টে স্যান্টানা জানান, রুডি নিজেকে জুলিও টোরেস বলে পরিচয় দিচ্ছেন, নিজেকে ১৪ বছর বয়সের বলে দাবি করছেন। কেউ তার কাছে গেলে আক্রমণাত্মক আচরণ করছেন।

পুলিশও এ দিন জানায়, বাড়ি থেকে প্রায় ১১ মাইল দূরে সাউথইস্ট হিউস্টনের ইম্যাকুলেট হার্ট চার্চের বাইরে রুডিতে পড়ে থাকতে দেখে নাইন-ওয়ান-ওয়ানে কল করেন এক ব্যক্তি। তার গায়ে আঘাতের বেশ কিছু চিহ্ন ছিল।


রুডির ‘নিখোঁজে’ স্যান্টানার সম্পৃক্ততার অভিযোগ

হিউস্টন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এইচপিডি) মিসিং পারসন ইউনিটের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ৫ জুলাই রুডি ও তার মা স্যান্টানার সঙ্গে একটি হোটেলে দেখা করে কথা বলেন।

একই দিন মা-ছেলের সঙ্গে ওই হোটেলে একা দেখা করতে যান বলে দাবি করেন স্থানীয় প্রভাবশালী স্যোশাল অ্যাক্টিভিস্ট ও কাউন্সেলর কোয়ানেল এক্স।

পুলিশ সেদিন কিছু জানায়নি। তবে চাঞ্চল্যকর তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেন কোয়ানেল এক্স।

তিনি দাবি করেন, রুডিকে এত বছর ঘরে আটকে রেখে তার ওপর ভয়ঙ্কর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন চালাতেন স্যান্টানা। আট বছর ধরে এসব সহ্য করেছেন বলে রুডি নিজেই তাকে জানিয়েছেন।

কোয়ানেল জানান, আরও আগে থেকেই নিজের ছেলেকে ‘যৌন দাস’ করে রেখেছিলেন স্যান্টানা। সইতে না পেরে ২০১৫ সালের ৬ মার্চ রুডি পালিয়ে যান। তবে নিরাপদ বোধ না করায় পরদিনই বাড়ি ফিরে আসেন।

স্থানীয় সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট কোয়ালেন এক্স

কোয়ানেলের দাবি অনুযায়ী, এরপরই রুডিকে বাড়িতে আটকে ফেলেন স্যান্টানা। তার ওপর চলতে থাকে নির্যাতন। এমনকি তাকে নেশাগ্রস্ত করে রাখা হয়। সুযোগ পেয়ে গত ২৯ জুন মায়ের গাড়ি ও ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আবারও‌ পালানোর চেষ্টা করেন রুডি। তবে চার্চের সামনে দুর্ঘটনায় গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে আহত হন। সে সময়ই তাকে স্থানীয় এক ব্যক্তি খুঁজে পান ও পুলিশে খবর দেন।


যা জানাল পুলিশ

কোয়ানেলের এসব দাবি প্রচার হওয়ার পরদিন ৬ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে এইচপিডি। ডিপার্টমেন্টের মিসিং পারসন ইউনিট কর্মকর্তা লুইটেন্যান্ট ক্রিস্টোফার যামোরা নিশ্চিত করেন, আট বছর আগে নিখোঁজের পরদিন বাড়ি ফেরেন রুডি ফারিয়াস। এত বছর নিজ বাড়িতেই ছিলেন।

তিনি এও নিশ্চিত করেন, স্যান্টানা ছেলের ফিরে আসার তথ্য গোপন করে রেখেছিলেন।

যামোরা বলেন, ‘জেইনি পুলিশকে বিভ্রান্তিতে রেখেছিলেন… স্বজন ও পরিচিতজনরা বাসায় যাকে দেখেছিলেন, তাকে ভাগনে বলে দাবি করেন।’

তবে কোয়ালেনের দাবি নিশ্চিত করেননি তিনি। জানান, রুডিকে ‘যৌন দাস’ করে রাখার অভিযোগের পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ পুলিশ পায়নি।

স্যান্টানার বিরুদ্ধে এখনই কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে না বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘আত্মগোপন করে থাকা তো কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নয়।’

এইচপিডি চিফ ট্রয় ফিনার জানান, ঘটনার তদন্ত একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে; শেষ হলেই বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে।


মা-ছেলে এখন কোথায়?

রুডির আন্টি পাওলেন স্যানশেয-রদ্রিগুয়েজ গত বৃহস্পতিবার জানান, স্যান্টানা রুডিকে এক সহকর্মীর বাড়িতে রেখে গা ঢাকা দিয়েছেন। তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করছেন, হিউস্টনেই কোথাও আত্মগোপন করে আছেন স্যান্টানা।

রুডির আন্টি পাওলেন স্যানশেয-রদ্রিগুয়েজ

ওই সহকর্মীর বাড়িতে গিয়ে রুডির সঙ্গে দেখা করেছেন স্যানশেয-রদ্রিগুয়েজ। সাংবাদিকদের তিনি জানান, মায়ের কাছে ফিরতে চান না বলে সাফ জানিয়েছেন তার ভাগনে।

স্যান্টানার বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো আইনি পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভও জানিয়েছেন তিনি।


স্যান্টানার পরিবারের সদস্য কারা

রুডির পুরো নাম রুডল্ফ রুডি ফারিয়াস ফোর্থ। হিউস্টনে ১৯৯৭ সালে তার জন্ম।

তার বাবা রুডল্ফ ফারিয়াস থ্রি হিউস্টনের পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। পরিবারে সৎ বড় ভাই চার্লস উরেস্টির সঙ্গে সবচেয়ে ভালো ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল রুডির।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০১১ সালে ২১ বছর বয়সে নিহত হন চার্লস। সে সময় রুডির বয়স ছিল ১৩। দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি ভাইয়ের রক্তাক্ত মরদেহ দেখেন। এরপর থেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

বড়ভাইয়ের সঙ্গে রুডি (বাঁয়ে) ও তাদের বাবা রুডল্ফ ফারিয়াস থ্রি

এ ঘটনায় তিন বছর পর নিজ বন্দুকের গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন রুডির বাবা ফারিয়াস থ্রি। টিকেটিং স্ক্যামের অভিযোগের জেরে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ফারিয়াস থ্রিয়ের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলছিল। এ কারণে তিনি আত্মহত্যা করেন।

স্যান্টানার দাবি অনুযায়ী, এই দুই ঘটনার নেতিবাচক প্রভাবে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন রুডি।

তবে এই নিখোঁজ-নাটকে রুডির মানসিক অসুস্থতার চেয়ে বেশি তার মা স্যান্টানার নির্যাতনকেই দায়ী করছেন পরিবারটির ঘনিষ্ঠজনেরা।


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন