জেনিন শিবিরের নিচে সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় ইযরায়েল

টিবিএন ডেস্ক

জুলাই ২২ ২০২৩, ১৩:১৮

জেনিন শরণার্থী শিবিরে একটি সুরঙ্গমুখ। ছবি: আল জাজিরা

জেনিন শরণার্থী শিবিরে একটি সুরঙ্গমুখ। ছবি: আল জাজিরা

  • 0

জেনিন শরণার্থী শিবিরে চলতি মাসের শুরুর দিকে ইযরায়েলের দুই দিনের বিমান ও স্থল হামলার শেষ দিকে ইযরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তারা একটি মসজিদে বেশ কয়েকজন প্যালেস্টেনিয়ান প্রতিরোধ যোদ্ধাকে ঘেরাও করেছে।

সেনাবাহিনী জানায়, আল-আনসার মসজিদের নিচের অংশ যেখানে কিছু সুড়ঙ্গ খুঁজে পাওয়া গেছে এবং সেগুলো বিস্ফোরক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে।

এ সময় তারা দাবি করে তাদের বাহিনী ‘একটি ভূগর্ভস্থ সন্ত্রাসী পথ নিষ্ক্রিয় করেছে’ এবং সুড়ঙ্গটি ‘অকার্যকর হয়ে পড়েছে’।

তবে প্যালেস্টাইন যোদ্ধারা যে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে মসজিদ থেকে নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তা ইযরায়েলি বাহিনী প্রকাশ করেনি। শিবিরের যোদ্ধারা এবং শিবিরের বাসিন্দারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

এক যোদ্ধা আল জাজিরাকে বলেন, ‘যোদ্ধারা অবরুদ্ধ ছিলেন, কিন্তু তারা পালাতে সক্ষম হন।’

জেনিনে চালানো এই অভিযানকে ২০০২ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা প্যালেস্টাইন গণঅভ্যুত্থানের পর কোনো ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরে সবচেয়ে বড় অভিযান হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

ইযরায়েল ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ২ থেকে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে ক্যাম্পে হামলা চালায় এবং শত শত সৈন্য হামলায় অংশ নেয়। তারা লোকজনের বাড়িঘরে অনুপ্রবেশ করে এবং ক্যাম্পের বড় অংশ ধ্বংস করে দেয়। এতে তিন শিশুসহ ১২ ফিলিস্তিনি ও এক ইযরায়েলি সৈন্য নিহত হন।

ইযরায়েলি অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল শিবিরে অবস্থান করা একটি ছোট, আন্তঃদলীয় প্যালেস্টাইন সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠী জেনিন ব্রিগেডকে দুর্বল করা।

তবে একাধিক যোদ্ধা আল জাজিরাকে বলেন, নিহতদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক এবং ইযরায়েলি সেনাবাহিনী বেশিরভাগ যোদ্ধাকে হত্যা বা আটক করতে ব্যর্থ হয়েছে।

হানি ওবায়েদ নামের এক জ্যেষ্ঠ যোদ্ধা আল জাজিরাকে বলেন, ‘তারা (ইযরায়েল) বলেছে যে তারা ১২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কেউই ব্রিগেডের সদস্য নন। তারা বয়স্ক ব্যক্তি এবং ব্রিগেডে জড়িত নন এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করেছে।

‘আসলে তাদের অপারেশন ব্যর্থ হয়েছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য যোদ্ধাদের হত্যা করা, কিন্তু যতবার তারা চেষ্টা করেছে, তারা ব্যর্থ হয়েছে। এটা সত্যি যে আমরা কয়েকজন যোদ্ধাকে হারিয়েছি, যাদের সবাই আমাদের প্রিয়, কিন্তু আমরা আশঙ্কা করছিলাম আরও যোদ্ধা নিহত হতে পারেন।’

জেনিন ব্রিগেডের বেশিরভাগ যোদ্ধা বেঁচে গেছেন এবং সুড়ঙ্গগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে বলে দাবির বিষয়ে মন্তব্যের জন্য আল জাজিরা ইযরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

জেনিনের নিচে টানেল

শিবিরের নিচে পাওয়া সুড়ঙ্গগুলো জেনিন শিবিরে একটি নতুন এবং নজিরবিহীন ঘটনা চিহ্নিত করে। জায়গাটি ২০০২ সালে মারাত্মক ইযরায়েলি আক্রমণের স্থান ছিল। এখানে ইযরায়েলি হামলায় ১১ দিনে ৫০ জনেরও বেশি প্যালেস্টেনিয়ান নিহত হয়েছিলেন।

সেনাবাহিনী সরে যাওয়ার পর সকালে আল জাজিরা মসজিদের নিচের সুড়ঙ্গগুলোতে প্রবেশ করে এবং দেখতে পায় যে সেগুলো অক্ষত রয়েছে। লাইটের জন্য বিদ্যুতের লাইন এবং খনন সরঞ্জাম এখনও ঠিক জায়গায় রয়েছে। সুড়ঙ্গগুলো প্রায় ১০ মিটার (৩৩ ফুট) গভীর এবং ১০০-১৫০ মিটার দীর্ঘ ছিল এবং সম্ভবত কয়েক মাস সময় নিয়ে খনন করা হয়েছিল।

আল জাজিরা যে সুড়ঙ্গগুলো দেখেছে তা দুটি জায়গায় অবস্থিত ছিল। শিবিরের আল-দামাজ পাড়ার আল-আনসার মসজিদের নিচে একটি সুড়ঙ্গ এবং হাওয়াশিন এলাকার একটি বাড়ির ভিতরে দ্বিতীয় একটি সুড়ঙ্গ, যেখানে জেনিন ব্রিগেডের সদর দফতর অবস্থিত ছিল। এটি এমন একটি অঞ্চল যা ইযরায়েল প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে।

শিবিরে বসবাসরত ফাতাহর রাজনৈতিক নেতা এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় সাবেক যোদ্ধা জামাল হুয়েল বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন সুড়ঙ্গগুলো ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের কৌশলের উন্নয়নকে সবার সামনে তুলে ধরে।

আল জাজিরাকে হুয়েল বলেন, ‘ইযরায়েলি দখলদাররা ড্রোন ও বিমানের মাধ্যমে যোদ্ধাদের পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের সরঞ্জাম তৈরি করেছে, সেনাবাহিনী যখন ক্যাম্পে হামলা চালায় তখন তারা (জেনিনরা) সহজেই নিরাপদ উপায় খুঁজে বের হয়ে যান।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে যোদ্ধারা মসজিদ থেকে সরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তারা ইযরায়েলি অভিযান ব্যর্থ করার জন্য এই সুড়ঙ্গগুলো ব্যবহার করেছিলেন। যোদ্ধারা আশেপাশেই আছেন এবং তারা সবাই ঠিক আছেন।’

তিনি বলেন, ইযরায়েলি সেনাবাহিনী হয়ত এসব সুড়ঙ্গের কথা আগে থেকেই জানত, কিন্তু তারা জানত না এগুলো কোথায় আছে।

ইযরায়েলের মেগিদ্দো কারাগার থেকে ২০০২ সালে নিজেকে বের করার চেষ্টা করা হুয়েল বলেন, তিনি এবং শিবিরের বাসিন্দারা সুড়ঙ্গ খননের জন্য যোদ্ধাদের ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছেন।

তিনি মন্তব্য করেন, ‘এটা সৃজনশীলতার বাইরে চলে গেছে। জেনিন শরণার্থী শিবিরটি পাথরের উপর নির্মিত। যুবকরা পাথরের ভেতর দিয়ে খনন করেছে। এটি খুবই কঠিন কাজ। এ ধরনের কাজের জন্য অসীম ধৈর্য, ইচ্ছা এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।’

হুয়েল বিশ্বাস করেন, ‘ইযরায়েল বিষয়টিকে আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে যাতে তারা আবার শিবিরে আক্রমণ করার অজুহাত হিসাবে এটিকে ব্যবহার করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্ষমতা খুবই অল্প ও সাধারণ। আমাদের তরুণ যোদ্ধারা তাদের কাছে যা আছে তার সর্বাধিক ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। তবে এটি অ্যামেরিকা সমর্থিত ইযরায়েলের শক্তির সঙ্গে তুলনীয় নয়।’

‘তারা অপমানিত হয়েছে’

ইযরায়েলি বাহিনীর দুই দিনের হামলায় ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরেও বাসিন্দারা বলেন, পরদিন সকালে শিবিরের রাস্তায় যোদ্ধাদের ঘুরে বেড়াতে দেখে তারা খুশি হয়েছেন।

আল জাজিরাকে মুতি আল-সাদি নামের এক স্থানীয় নাগরিক বলেন, ‘সমস্ত বিল্ডিং, আসবাবপত্র, বাড়ি, গাড়ি এগুলি সবই প্রতিস্থাপন করা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যোদ্ধারা নিরাপদে আছেন।’

আমানি আবদুল্লাহ নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা আমাদের যোদ্ধাদের জন্য খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহকে ধন্যবাদ, তারা সবাই নিরাপদে আছেন।’

আমানি বলেন, ‘পরের দিন যখন তারা (যোদ্ধারা) উপস্থিত হতে শুরু করেন, তখন মনে হচ্ছিল যেন আমি আমার ছেলেকে দেখেছি।’

আমানির ছেলে ব্রিগেডের সদস্য ছিলেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইযরায়েলের হাতে নিহত হয়েছেন। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘লড়াই এখনও শেষ হয়নি।’

আমানি আরও বলেন, ‘এরা আমাদের সন্তান। তারা ৪৮ ঘণ্টা ধরে খাবার ও পানি ছাড়াই লড়াই করছেন। কিন্তু তারপরও রয়েছে সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা। কবে পর্যন্ত আমরা এভাবে বাঁচব?’

এদিকে ৪১ বছর বয়সী বাসিন্দা বাসেম তাহাইনেহ বলেন, শিবিরে হামলা বাসিন্দাদের স্বাধীনতার সংকল্পকে চ্যালেঞ্জ করেনি।

ইযরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের পর সকালে ক্যাম্পে নিজের বাড়ি থেকে আল জাজিরাকে তাহাইনেহ বলেন, ‘তারা আমাদের সঙ্গে যা করেছে তা আমাদের এর চেয়েও বেশি কিছু করতে এবং প্রতিরোধকে আরও শক্তিশালী করতে উৎসাহিত করে। তারা (ইযরায়েলিরা) অপমানিত হয়েছে। তারা শিবিরে তাদের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। আপনি যখন রাস্তা এবং বাড়িঘর ধ্বংস করেন তখন এটি কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ? তারা তরুণদের কিছুই করতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘এই তরুণরা আমাদের গর্ব। তারাই আমাদের মধ্যে সম্মানিত। জেনিন শিবিরের মধ্যে আমাদের হৃদয় একে অপরের সঙ্গে রয়েছে। আমরা সবাই প্রতিরোধের সঙ্গে আছি।’

যোদ্ধাদের কাছে, জেনিন ব্রিগেডকে দমন করতে ইযরায়েলের ব্যর্থতার অর্থ হচ্ছে ইযরায়েলি সেনাবাহিনীর আরেকটি অভিযান এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

ওবায়েদ বলেন, ‘আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। যখন তারা ফিরে আসবে, আমরা প্রস্তুত থাকব।’


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন