স্কলারশিপের মাধ্যমে আফগান নারীদের অ্যামেরিকা স্বপ্নপূরণ

টিবিএন ডেস্ক

জুলাই ২৫ ২০২৩, ১৯:২৮

অ্যামেরিকায় পড়াশোনা করছেন আফগান নারী ফাহিমা সুলতানি। ছবি: সংগৃহীত

অ্যামেরিকায় পড়াশোনা করছেন আফগান নারী ফাহিমা সুলতানি। ছবি: সংগৃহীত

  • 0

আফগানিস্তান থেকে অ্যামেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পর ২০২১ সালের আগস্টে নারী শিক্ষার্থীরা দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে পড়েন। তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সংগঠন স্কলারশিপের জন্য তহবিল জোগার করতে শুরু করে।

তালেবানরা ২০২১ সালের গ্রীষ্মে যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলে নেয়, তখন নারীরা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে ওঠে। এমনই একজন ফাহিমা সুলতানি। তিনি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক সহপাঠী সে সময় কয়েক দিন ধরে কাবুল বিমানবন্দরে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে বন্দুকধারী চরমপন্থীরা তাদের প্রতিবারই ফিরিয়ে দেয়।

তাদের দুজনকে বলা হয়, ‘লেখাপড়ার কোনো প্রয়োজন নেই, বাড়ি ফিরে যান।’

এর প্রায় দুই বছর পর ২১ বছর বয়সী সুলতানি অ্যামেরিকায় পৌঁছাতে পেরেছেন। স্কলারশিপে অ্যারিজোনা স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে (এএসইউ) ডেটা সায়েন্সে পড়াশোনা করছেন। অবসর পেলে হাইকিংয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি।

নাইন ইলেভেনের হামলার ঘটনার পর ২০০১ সালে তালেবানকে আফগানিস্তান থেকে উৎখাত করে অ্যামেরিকা। তখন থেকে পরবর্তী কয়েক বছর সুলতানির প্রজন্মের মেয়েরা সে দেশের নারীদের অবাধে শিক্ষা লাভ করতে ও ক্যারিয়ার গড়তে দেখে বড় হয়েছেন।

তালেবান ২০২১ সালে ক্ষমতা পুনর্দখলের পর সেখানে নারী স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ শুরু হয়। এর পরপরই অ্যামেরিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আফগান নারীদের জন্য দরজা খুলে দিতে থাকে।

ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনের সিইও অ্যালান গুডম্যান বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, “কাবুলে সরকারের পতনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই অ্যামেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঘোষণা দিতে থাকে- ‘আমরা এক জনকে নেব’, ‘আমরা তিন জনকে নেব’, ‘আমরা এক জন প্রফেসরকে নেব’, ‘আমরা এক জন শিক্ষার্থীকে নেব।’”

আফগানিস্তানে তালেবান সরকার এখন নতুন নিয়ম জারি করেছে। সেদেশে এখন মেয়েরা ৬ষ্ঠ শ্রেণির পর আর স্কুলে যেতে পারে না। তাদের জন্য বোরকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, পার্ক ও জিম। চাকরির সুযোগ করা হয়েছে সীমিত। সবশেষ নিষেধাজ্ঞা এসেছে বিউটি পার্লারের ওপর।

আফগানিস্তান থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পালিয়ে অ্যামেরিকায় আশ্রয় নেয়া ৬০ জনেরও বেশি আফগান নারীদের একজন সুলতানি।

এএসইউর গ্লোবাল অ্যাকাডেমিক ইনিশিয়েটিভসের নির্বাহী পরিচালক ও হেড অফ অপারেশনস সুসান এডগিংটন বলেন, ‘এই নারীরা একটি সংকট থেকে বেরিয়ে এসেছেন। একটি বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তারা কোথায় যাচ্ছেন তা না জেনেই বিমানে চড়ে অ্যামেরিকায় পৌঁছেছেন।’

অ্যামেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে গত দুই বছর পড়াশোনা করার পর অনেকেই গ্র্যাজুয়েশনের শেষের দিকে পৌঁছেছেন। তারা এখন ভবিষ্যত ক্যারিয়ারের পরিকল্পনা করছেন।

অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ আফগানিস্তান থেকে গ্র্যাজুয়েশনের মাত্র কয়েক মাস বাকি থাকতে দেশ ছাড়তে হয় ২২ বছর বয়সী মাশাল আজিজকে। বিমানে উঠে তিনি ইন্টারনেটে স্কলারশিপ দেয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার খোঁজ শুরু করেন।

আজিজ বলেন, ‘আমি সব ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম এখন উচ্চশিক্ষার জন্য আর কত বাঁধার মুখে পড়তে হতে পারে।’

আফগানিস্তান ছাড়ার পর কয়েক মাস তাকে ও আরও তিন শিক্ষার্থীকে কাতারে ও পরে নিউ জার্সির একটি সামরিক ঘাঁটিতে থাকতে হয়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বোস্টন পৌঁছে নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে তারা ভর্তি হন।

আজিজ এই স্প্রিংয়ে ফাইন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিং ম্যানেজমেন্টে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নর্থইস্টার্নে এই ফলে ফাইন্যান্সে তার মাস্টার্স ডিগ্রিতে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

আজিজ বলেন, যেসব শিক্ষার্থী চলে এসেছেন, তাদের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ভাষাগত সমস্যা সমাধান করার জন্য সাহায্য প্রয়োজন। এর সঙ্গে নিজ দেশে সম্পন্ন করা কোর্সের ক্রেডিট পাওয়া থেকে শুরু করে টিউশনের খরচ বহন করা পর্যন্ত সবকিছু অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

কাবুলের পতনের মাত্র দুইদিন পর ওকলাহোমার ইউনিভার্সিটি অফ টুলসা ঘোষণা করে যে তারা অ্যামেরিকায় আশ্রয় নেওয়া আফগানদের জন্য দুটি স্কলারশিপ দিচ্ছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টি আরও পাঁচটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম তৈরি করে যা এই অঞ্চলে বসবাস করা কিছু তরুণ আফগানদের জন্য প্রযোজ্য। আরও পাঁচজন আফগান এ বছর স্ক্লারশিপ পেয়েছেন।

আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া অনেক তরুণের জন্য অ্যামেরিকা পরিচিত হওয়ায় দেশটি একটি স্বাভাবিক গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।

আফগানিস্তানের ২৪ বছর বয়সী হামাসা জিরাক ও তার ৩০ বছর বয়সী স্বামী হুসেইন সাইফনিজাতের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। কাবুলে জিরাক আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ আফগানিস্তানে পড়াশোনা করেছেন। সাইফনিজাত অ্যামেরিকাভিত্তিক একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।

তারা দুজনেই গত ফলে নিউ জার্সির রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সাইফনিজাত ইলেকট্রিক অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক শেষ করেছেন। জিরাক ব্যবসায় প্রশাসনে ২০২৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশোনা করছেন।

জিরাক বলেন, ‘শুরুতে আমার উদ্বেগ অনেক ছিল কারণ আমি অ্যামেরিকায় কীভাবে আমাদের জীবন চালিয়ে যাব তা নিয়ে ভাবছিলাম। কীভাবে চাকরি পাব সে নিয়ে শুরুতে কিছুটা চাপ থাকলেও এখন সবকিছু মসৃণভাবে চলছে।’

আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়া অন্য অনেকের মতো সুলতানিও প্রায়শই অন্যান্য আফগান নারীদের কথা চিন্তা করেন। যাদের মধ্যে তার বোনও রয়েছে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল কিন্তু এখন তাকে বাড়িতে বসে থাকতে হবে।

সুলতানি বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারি অথচ আফগানিস্তানে মিলিয়ন মিলিয়ন মেয়ে আছে যারা আমার মতো সুযোগ পাচ্ছে না। আমি যেভাবে চাই সেভাবে পোশাক পরতে পারি কিন্তু আফগানিস্তানে এখন মিলিয়ন মিলিয়ন মেয়ে আছে তাদের এই সুযোগ নেই।’

বোলিং গ্রিনের ওয়েস্টার্ন কেন্টাকি ইউনিভার্সিটিতে (ডব্লিউকেইউ) ২০ জন আফগান এই ফলে পড়াশোনা করবে বলে জানা গেছে। গত দুই সেমিস্টার ধরে ৪৬ বছর বয়সী আতিফা কাবুলি এখানে নার্সিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এখন তিনি অ্যামেরিকায় চিকিৎসা নিয়ে কাজ করার অনুমতি পাওয়ার জন্য পরীক্ষার দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আগত বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর চেয়ে বয়সে বড় কাবুলি একজন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে তার কর্মজীবন ছেড়ে এসেছেন। তালেবানের প্রথম শাসনামলে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানে পড়াশোনা করার কারণে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছেন।

তালেবানরা নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পর তিনি জানতেন তাকে এবং তার স্বামীকে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যেতে হবে যাতে তাদের ১৫ এবং ১০ বছর বয়সী মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে। তিনি বলেন, ডব্লিউকেইউতে তার কাটানো সময় তাকে অ্যামেরিকায় মেডিকেল লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস করে তুলেছে।

স্কলারশিপের প্রাথমিক ধাক্কার পর থেকে আফগান শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিভিন্ন সংগঠন। যার মধ্যে রয়েছে কাতার স্কলারশিপ ফর আফগানস প্রজেক্ট। যা অ্যামেরিকার কয়েক ডজন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫০ টি বৃত্তির তহবিল প্রদানে সহায়তা করেছে।

এখনও অ্যামেরিকায় যাওয়ার পথ খুঁজছেন ২৬ বছর বয়সী ইয়াসমিন সোহরাবি। যিনি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ আফগানিস্তানে আইন নিয়ে পড়ছিলেন। অ্যামেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে বিদেশে যেতে হবে।

তালেবানরা কাবুল দখল করার পরের দিন তিনি ডাব্লুকেইউতে তার ভর্তির কথা জানতে পারেন। তবে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে ঢুকতে পারেননি।

তিনি ও তার ছোট বোন এক বছর পরে পাকিস্তানে ভিসা পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। এখন তারা অ্যামেরিকায় প্রবেশের উপায় খুঁজছেন। তাদের ভাই যিনি তাদের সঙ্গে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন তারাও স্কুলে আবেদন করছেন।

সোহরাবি বলেন, তিনি ও তার ভাই-বোনরা যা হারিয়েছেন সেটা নিয়ে না ভেবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এবং কিভাবে অ্যামেরিকায় যাওয়া যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করছেন তারা।


0 মন্তব্য

মন্তব্য করুন